তিন বছর আগের কথা। কটিয়াদীর সহশ্রাম ধুলদিয়া ইউনিয়নের দেওজান গ্রামের প্রান্তিক চাষি অনিল দাস এবং তাঁর ভাই সুনীল দাস বাড়ির সামনের হাওরের বোরো জমিতে সেচ দিচ্ছিলেন। পানির স্তর নেমে যাওয়ায় ছয়-সাত ফুট মাটির নিচে তাঁরা শ্যালো মেশিন বসান। সেদিন ছিল রবিবার, শেষ চৈত্র। গভীর রাতে কালার ভাই মিলন এবং ছেলে জসিমসহ একদল দুর্বৃত্ত ওই মেশিন ছিনিয়ে আনতে যায়। বাধা দিতে গেলে দুর্বৃত্তরা দুই ভাইকে কুপিয়ে জমিতেই ফেলে রাখে। ছয় দিন পর অনিল দাস (৫৬) চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। অনিলের মৃত্যুর পর পরিবারের পক্ষ থেকে থানায় অভিযোগ দায়ের করতে গেলে পুলিশ অভিযোগ গ্রহণ করেনি বলে অভিযোগ রয়েছে। হত্যাকাণ্ডের পর তিন বছর পার হয়ে গেলেও এ ব্যাপারে অনিলের পরিবার আইনগত বিচার থেকে বঞ্চিত হয়েছে। প্রাণভয়ে তারা আর বিচার চাওয়ারও সাহস দেখায়নি। পাঁচ মেয়ের বাবা অনিল মারা যাওয়ায় পরিবারটি এখন খুবই কষ্টে আছে।কালা এবং তার ভাই-ভাতিজাদের বিরুদ্ধে থানায় খুন, হত্যার উদ্দেশ্যে নির্যাতন, ডাকাতি ও নারী নির্যাতনসহ বিভিন্ন সময় কমপক্ষে ৫০টি মামলা হয়। এর মধ্যে কমপক্ষে তিনটি হত্যা মামলা। অধিকাংশ মামলাই সাক্ষীর অভাবে খারিজ হয়ে গেছে। কালারা শত শত অপরাধমূলক কাজ করলেও আক্রান্তরা থানায় মামলা দায়ের করার সাহস পান না। সরেজমিনে জানা যায়, রায়খলার যুবক শাহজাহান বিদেশে যাওয়ার টাকা সংগ্রহ করেছেন খবর পেয়ে কালা-মিলনরা বাড়িতে হানা দেয়। শাহজাহানের ১৩ বছর বয়সী বোন জুয়েনা তাদের চিনে ফেলায় সঙ্গে সঙ্গে তারা তাকে কুপিয়ে হত্যা করে। জুয়েনার মা ফরিদা বেগম জানান, হত্যা মামলা দায়ের করা হলেও সাক্ষীরা আদালতে যেতে সাহস পান না।

২০১১ সালের ১০ নভেম্বর বড় হাওরে অজ্ঞাত পরিচয় তরুণীর ক্ষতবিক্ষত লাশ পাওয়া যায়। এ ঘটনায় স্থানীয় চৌকিদার কাজল মিয়া বাদী হয়ে থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। পরে ওই মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া প্রধান সন্দেহভাজন আসামি নওবাড়িয়ার সুজন পুলিশ রিমান্ডে কালার ভাই মিলন এবং কালার দুই ছেলে জসিম ও স্বপনের নাম প্রকাশ করে। পরে তিনজনকেই পুলিশ হত্যা মামলায় আসামি করে। পুলিশ জানায়, মেয়েটিকে পাশবিক নির্যাতনের পর খুন করা হয়েছে। কালা, তার ভাই, ছেলে ও ভাতিজারা এতটাই দুর্ধর্ষ যে, যখন-তখন যার-তার ওপর তারা হামলা চালায়। দিন বা রাত নেই, যখন যাকে মন চায় ধর্ষণ করে। তাই কেউ তাদের ছায়াও মাড়াতে যায় না। এমনকি পুলিশের লোকজনও তাদের ভয় পায় বলে জনশ্রুতি রয়েছে। কয়েক বছর আগে কালার ভাই মলু (গণপিটুনিতে নিহত) কটিয়াদী থানার এক উপপরিদর্শককে মাথার ওপর তুলে মাটিতে আছড়ে ফেলে দেয়।

গা শিউরে ওঠা ঘটনাটি দুই বছর আগের। রায়খলার এক সংখ্যালঘু পরিবারের স্কুলপড়ুয়া মেয়েকে অস্ত্রের মুখে মিলন বাড়ি থেকে তুলে নেয়। নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো জানায়, কয়েক ঘণ্টা আটকে রেখে মেয়েটির ওপর পাশবিক নির্যাতন চালানো হয়। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে আসে। পরে স্থানীয় চেয়ারম্যানসহ পুলিশ মেয়েটিকে উদ্ধার করে। বাগপাড়া গ্রামের এক দরিদ্র যুবতী বাড়ির পাশের দোকানে কেরোসিন আনতে যায়। এ সময় মিলন এবং তার চাচাতো ভাই লাল মিয়া রাস্তা থেকে ধরে নিয়ে তাকে ধর্ষণ করে। এক বছর আগের ওই ঘটনায় মেয়েটির পরিবার কারো কাছে বিচার পর্যন্ত চায়নি। স্থানীয় এক ধর্মপ্রাণ ব্যক্তির মেয়েকেও কিছুদিন আগে ধর্ষণ করে মিলনের নেতৃত্বে একদল দুর্বৃত্ত। এ নিয়ে গ্রামে সংঘর্ষ বাধে। তবে ঘটনার ব্যাপারে থানায় কোনো মামলা হয়নি।

স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানান, কালা-মিলনদের চাঁদা না দিয়ে তাঁরা ব্যবসা করতে পারেন না। নিয়মিত চাঁদার টাকা পরিশোধ করতে হয়। তা না হলে নেমে আসে নির্যাতন। চাঁদার জন্য কালা-মিলনরা বহু ব্যবসায়ী কিংবা তাঁদের পরিবারের সদস্যদের প্রহার করেছে। এক সংখ্যালঘু ব্যবসায়ীর ভাষ্য, চাঁদার টাকা দিতে দেরি করায় মিলন তাঁর মেয়েকে তুলে নিতে চেয়েছিল। নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় কয়েকজন জনপ্রতিনিধি মনে করেন, কালা-মিলনদের সন্ত্রাস প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেও সাক্ষীর অভাবে বিচার পাওয়া যায় না। কেউ প্রতিবাদ করলে তার আর রক্ষা নেই। তামসুর মৃত্যুর পর এলাকাটি কিছুদিন শান্ত ছিল। কয়েক বছর ধরে আবার শুরু হয়েছে সন্ত্রাস। কালাদের কারণে এলাকার ভীষণ দুর্নাম হচ্ছে। অনেকেই এ অঞ্চলে মেয়ে বিয়ে দিতে ভয় পায়। আবার অনেকে বেড়াতে আসতে চায় না। এগুলোর একটা স্থায়ী বিহিত হওয়া দরকার।

কটিয়াদী উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মুক্তিযোদ্ধা মো. ময়েজউদ্দিন জানান, তিনি নিজেও কালাদের আক্রমণের হাত থেকে রেহাই পাননি। তিনি জানান, ওদের জুলুম-নির্যাতন সইতে না পেরে তিনি প্রতিবাদ করেছিলেন। এর প্রতিশোধ নিতে কালার নেতৃত্বে তার ভাইয়েরা তাঁর ওপর হামলা চালায়। ছুরিকাঘাতে তাঁর ভুঁড়ি বেরিয়ে পড়ে। কেটে দেয় হাতের রগ। পরে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেওয়া টাকায় চিকিৎসা করে সুস্থ হলেও এখন অনেকটাই পঙ্গু জীবন কাটাচ্ছেন তিনি। কালা ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে মেম্বার পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে হেরে যায়। বিপুল ভোট পেয়ে জয়ী হন দেওজান গ্রামের হাজি সামিরউদ্দিনের ছেলে লিটন মিয়া। শুধু এই ‘অপরাধে’ কালা পিটিয়ে লিটনের বৃদ্ধ বাবার চারটি দাঁত ফেলে দেয়। গৌরীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক মুক্তিযোদ্ধা মো. আব্দুস সালামকে ধুলদিয়া বাজারে প্রকাশ্যে মারধর করে। এলাকার বহু গণ্যমান্য ব্যক্তি কালাদের হাতে অপমানিত ও প্রহারের শিকার হয়েছেন।

বেপরোয়া সন্ত্রাস-চাঁদাবাজির অভিযোগ সম্পর্কে জানতে প্রধান অভিযুক্ত কালা মিয়াকে এলাকায় খোঁজ করে পাওয়া যায়নি। স্থানীয়রা জানায়, কালা মোবাইল ফোন ব্যবহার করে না। আরেক কুখ্যাত সন্ত্রাসী এবং কালার ভাই মিলন মিয়ার মোবাইল ফোনে শনি ও রবিবার (১ ও ২ সেপ্টেম্বর) বার বার কথা বলার চেষ্টা করা হলেও ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। এলাকাবাসী জানায়, ওরা সাধারণত ফোন বন্ধ রাখে। কিশোরগঞ্জের দানাপাটুলী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. জালালউদ্দিন মাস্টার কালাদের অত্যাচার-নির্যাতনের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, ‘এদের হাতে বহু মানুষ জিম্মি। এরা যেসব অপরাধ করছে, তা ক্ষমার অযোগ্য। কিছুদিন এলাকাটা শান্ত ছিল। কালাসহ তামসুর কয়েকজন শিষ্য মাথাচাড়া দিয়ে ওঠায় এখন আবার অশান্ত হয়ে উঠছে। শেষ পর্যন্ত নিজের মামাকে প্রকাশ্যে খুন করতেও এরা দ্বিধা বোধ করেনি।’

কটিয়াদীর সহশ্রাম-ধুলদিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আলতাফউদ্দিন শাহীন বলেন, ‘তামসুর মৃত্যুর পর কালাদের অত্যাচারে জর্জরিত হয়ে আছে ১০-১২টি গ্রামের মানুষ। শিশু থেকে বৃদ্ধ_কেউ কালাদের হাত থেকে রেহাই পায়নি। নারীরা এদের হাতে সবচেয়ে বেশি অনিরাপদ। আমাদের এমনই দুর্ভাগ্য যে, এখন আর আমাদের এলাকায় কেউ মেয়ে বিয়ে দিতে চায় না। বাইরের লোকজন ভয়ে এলাকায় বেড়াতেও আসতে চায় না।’ কালা-মিলনদের কবল থেকে বড় হাওরবাসী কবে রক্ষা পাবে_এমন প্রশ্নে কটিয়াদী থানার ওসি ফরিদ আহমেদ জানান, পুলিশ একা কালাদের ভালো করতে পারবে না। সামাজিকভাবে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।

তিনি আরো জানান, বড় হাওরপারে যেতে হলে কয়েক কিলোমিটার হাঁটতে হয়। সহজেই অপরাধীরা পুলিশ আসার খবর পেয়ে যায়। তিনি কালা-মিলনদের ধরতে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের সহায়তা কামনা করে জানান, সবার পরিচয় গোপন রাখা হবে।

লিখেছেনঃ নাসরুল আনোয়ার, কালেরকণ্ঠ প্রতিনিধি