ইরানী বিশ্বাসঃ
মহাভারতের বিখ্যাত পঞ্চপান্ডব ছলনাপূর্ণ পাশাখেলার পরিণতিতে পরজিত হয়েছিলেন। শর্তসাপেক্ষে তারা ১২ বছর বনবাস এবং এক বছর অজ্ঞাত বাসের লক্ষ্যে হস্তিনাপুর পরিত্যাগ করেছিলেন। অজ্ঞাতবাসের সময়ে বীরশ্রেষ্ঠ গান্ডিবধারী অর্জুন নারীরূপী বৃহন্নলার ছদ্মবেশে চাকরি নিয়েছিলেন বিরাট রাজার অন্তঃপুরে। সেখানে রাজা বিরাট কন্যা উত্তরাকে নাচ-গান শেখানোর দায়িত্ব নিয়েছিলেন তিনি। রাজার উদ্দেশ্য ছিল মেয়েরূপী হিজড়াকে কন্যার সতিত্ব ও নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্বে নিযুক্ত করা। রাজা অবশ্য শেষ রক্ষা করতে পারেনি। পরবর্তীতে অর্জুন উত্তরাকে অপহরণ করে বিয়েও দিয়েছিলেন নিজপুত্র অভিমন্যুর সঙ্গে।
যাক সেসব কথা। আমি এখানে ‘হিজড়া’ শব্দের সঙ্গে পরিচয় করাতে চেয়েছি। বাংলা অভিধানে বলা হয়েছে হিজড়া শব্দটির আগমন হয়েছে হিন্দি থেকে। সংস্কৃত ভাষায় নপুংসক শব্দটি পাওয়া যায়। প্রকৃতপক্ষে হিজড়া শব্দটি অশোভন মনে হলেও বাংলাতে হিজড়া বোঝানোর জন্য কোনও শোভন শব্দ পাওয়া যায়নি। সাধারণ অর্থে হিজড়ার অভিধানিক অর্থ বলতে আমরা বুঝি একই দেহে নারী ও পুরুষের চিহ্নযুক্ত মানুষ। যারা সন্তান উৎপাদনে অক্ষম। হিজড়া শব্দটি মুলত পুরুষ বাচক। যার স্ত্রী বাচক শব্দ হিজড়ানি হতে পারে। তবে হিজড়ার স্ত্রী বাচক শব্দটি একেবারেই কাল্পনিক।
হিজড়া শব্দটির ইংরেজি প্রতিশব্দ Hermaphrodite. যার আভিধানিক অর্থ উভয়লিঙ্গ। Hermaphrodite শব্দটির উৎপত্তিগত অর্থ গ্রিক পৌরানিক কাহিনীতে নিহিত আছে। হেলেনিষ্টিক যুগের গ্রিক পুরাণের দুটি চরিত্র হার্মেস এবং আফ্রেদিতি থেকে এসেছে হার্মাফ্রোডাইট শব্দটি। পুরাণে পাওয়া গেছে হার্মেস ও আফ্রোদিতি দম্পতির সুদর্শন পুত্র হার্মাফ্রোদিতাসের প্রেমে পড়ে ঝরণার উপদেবী। উপদেবী দেবতাদের কাছে প্রর্থনা করে , সে যেন চিরতরে হার্মাফ্রোদিতাসের সঙ্গে একীভূত হতে পারে। দেবতারা তার প্রার্থনা মঞ্জুর করেন। এর ফলে দুজনের সংমিশ্রনে তৈরি হয় একজন অর্ধপুরুষ ও অর্ধনারী বিশিষ্ট মানুষ। ইংরেজিতে হিজড়ার প্রতিশব্দ হিসেবে ইউনাক শব্দটি ব্যবহৃত হয়, যার অর্থ নপুংসক বা খোজা। চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের মতে ক্রোমোজোমের ত্রুটির কারণে জন্মগত যৌন প্রতিবন্ধী ব্যক্তি যাদের জন্মের পর লিঙ্গ নির্ধারণে জটিলতা দেখা দেয়, তারাই হিজড়া।
পৃথিবীতে কখন থেকে হিজড়াদের আবির্ভাব হয়েছে তা সঠিক জানা যায়নি। তবে নৃতত্ত্ববিদদের মতে, যখন থেকে পৃথিবীতে মানব জাতির আবির্ভাব তখন থেকেই হিজড়ার আবির্ভাব। পাশ্চাত্যের হিজড়ারা জনসাধারনের মুল ধারার অর্ন্তভূক্ত হলেও আমাদের দেশে তা নয়। আমাদের দেশের হিজড়ারা সমাজে অপাংক্তেয় শ্রেণী হিসাবে গন্য। গর্ভজাত সন্তান ছেলে হবে না মেয়ে হবে তা এখন আগে থেকেই জানা সম্ভব। কিন্তু উনিশ শতকের পূর্ব পর্যন্ত এ বিষয়টি মোটেই সম্ভব ছিল না। চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের অনেক সাধনার পর উনিশ শতকের শেষ দিকে ক্রোমোজোম সম্পর্কিত গবেষণায় অবিশ্বাস্য সাফল্য আসে। এ ভাবেই নবজাতকের লিঙ্গ নির্ধারন সম্ভব হয়। অনেক সময় ক্রোমোজোমের অস্বাভাবিক মিলনের ফলে শিশুর লিঙ্গ নির্ধারন সম্ভব হয় না। ডাক্তারদের মতে এ শিশুটিই হিজড়া।
মুঘল শাসকদের কাছে হিজড়ারা ছিল অত্যন্ত বিশ্বস্ত ভৃত্য। হিজড়ারা অদ্বিতীয় যৌনসত্তার জন্য অবাধে পুরুষ ও মহিলা মহলে যাতায়াত করতে পারত। এ কারনে মুঘল সম্রাটদের হেরেমের সবচেয়ে মুল্যবান নারীদের পাহারা দেয়া এবং তাদের ছেলেমেয়েদের দেখাশোনা করত বিশ্বস্ততার সঙ্গে। এরা এতই বিশ্বস্ত ছিল যে সম্রাটের অনেক গোপন দায়িত্ব পালন, এমনকি সন্তান প্রসবের সময় সম্রাট ছাড়া শুধু হিজড়াদেরই প্রবেশাধিকার ছিল। বেইমানি এরা কখনোই করতা না। কারও প্রতি বিশ্বাস জমে গেলে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তা বজায় রাখত। তাই মুঘলদের সময়ে এরা ছিল সবচেয়ে নিরাপদ কর্মী।
বর্তমানে বাংলাদেশে হিজড়ার সংখ্যার সঠিক পরিসংখ্যান জানা নেই। ধারণা করা যায় প্রত্যেক জেলাতেই কমবেশি হিজড়া আছে। তবে হিজড়া সংগঠন গুলোর কাছ থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে এক লাখেরও বেশি হিজড়া আছে। স্বাভাবিক সন্তানদের মত এদের জন্ম হয়। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে এরা বুঝতে পারে তারা স্বাভাবিক নয়। এ সময় তারা মানসিক ভাবে যন্ত্রণায় ভোগে। ক্রমে ক্রমে এ যন্ত্রণা তাদের পরিবারের কাছ থেকে অলিখিত দূরত্ব বাড়িয়ে দেয়। তখন পরিবার ছেড়ে এরা গুরুমার আশ্রয়ে ওঠে। হিজড়া সমাজের সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারী হল গুরুমা। গুরুমাকে সবাই মা বলে ডাকে, আর শিষ্যরা হয়ে ওঠে তার সন্তানের সমান। এক একজন গুরুমার অধীনে গড়ে ওঠে এক একটি পরিবার।
হিজড়ারা তাদের গুরুমার গুরুকে নানি, গুরুমার সমপর্যায়ের হিজড়াদের খালা এবং অন্য হিজড়াদের বোন বলে সম্বোধন করে। নতুন সদস্য দলে ঢোকার পর গুরুমা তাদের নাচ, গান, ঢোল বাজানো, বিভিন্ন নিয়ম-কানুন, তালি বাজানো প্রভৃতি শিক্ষা দেয়। এভাবেই একজন নতুন সদস্য দলের পরিপূর্ন সদস্য হয়ে ওঠে। হিজড়া সমাজের বাসিন্দারা একান্তই নিজেদের ভাষায় কথা বলে। বাংলায় কথা বললেও যেখানে আশঙ্কা, গোপনীয়তা এবং কৌশলের প্রশ্ন জড়িত থাকে সেখানে তারা নিজেদের ভাষায় কথা বলে ব্যাকরণবিহীন হিজড়া ভাষাচর্চার কোনও প্রামান্য ইতিহাস খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে এখন পর্যন্ত তাদের ভাষা ঐতিহ্য ধরে রেখেছে তারা।
পৃথক সমাজ ব্যবস্থায় হিজড়াদের আইন-সালিশ ও বিচার আমারদের থেকে ভিন্ন। দেশের প্রচলিত বিচার ব্যবস্থায় এরা সাধারণত শরণাপন্ন হয় না। এদের সমাজে ন্যায়-অন্যায়ের বিচার এদেরে নিয়মেই চলে। বৃহৎ কোনও ঘটনা ছাড়া সব ধরনের অপরাধের বিচার করেন গুরুমা। বাংলাদেশে হিজড়াদের উচ্চ বিচারালয় সাভারে। বছরে একবার এদের সমাজের অভ্যন্তরীন বড় ধরনের অপরাধের বিচার হয়। সাধারণত অর্থদণ্ডই সব অপরাধের শাস্তি হিসাবে গণ্য করা হয়। অপরাধের ওপর ভিত্তি করে শাস্তির দণ্ড নির্ধারন করে গুরুমা অথবা বিচারকরা। যুগ যুগ ধরে নিজস্ব বিচার ব্যবস্থা লালন করে আসছে হিজড়ারা। এবং নিজেদের বিচার ব্যবস্থার প্রতি এদের রয়েছে পরম শ্রদ্ধা ও আস্থা।
হিজড়াদের জীবনেও সাধারণ মানুষের মত প্রেম-ভালোবাসার ব্যাপারগুলো আসে। এর পরিনতি হিসাবে বিয়ে পর্যন্ত গড়ায়। একই লিঙ্গের দু’জন অথচ ঘর বাঁধার স্বপ্ন। আবার অনেকেই নিজের গণ্ডির বাইরে অন্য পুরুষের সঙ্গে সর্ম্পক গড়ে। তবে সে বিয়ে বেশি দিন টিকে থাকে না। এর প্রধান কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম দুটি কারণ হল, বংশবৃদ্ধি করতে না পারা। এছাড়া আমাদের সমাজে হিজড়া বিয়ে বৈধ নয়।
কিছুদিন আগে পর্যন্ত দেখা যেত কারো বাড়িতে নবজাতকের জম্মের খবর পেয়ে দল বেধে রংবেরংয়ের পোশাক পরে এক দল হিজড়া আসছে। তাদের হাতে থাকা ঢোল বাজিয়ে নানা সুরে গান গাইত। সকলের ধারনা ছিল হিজড়া দিয়ে নাচ গান করালে সন্তানের মঙ্গল হয়। হিজড়ারাও নবজাতকের মাথায় তেল দিয়ে দোয়া করত। সময়ের বিবর্তনে বদলে গেছে দিন। বদলে গেছে প্রাচীন ঐতিহ্যের ধারা। এখনকার প্রজন্মের কাছে হিজড়াদের সেই ঐতিহ্যের কোন ছোঁয়া নেই।
তাগিদে তারা আজ আয়ের পথ পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছে। বর্তমানে তারা বিভিন্ন ভাবে আয় করে জীবিকা নির্বাহ করছে। হাটে বাজারে তোলা ওঠানো, সামাজিক অনুষ্ঠানে নাচগান করা, সিনেমার এক্সট্রা, অভিনয়, গৃহভৃত্য, বিভিন্ন ধরনের ফ্যাক্টর শ্রমিক, এনজিওতে চাকরি, বাবুর্চি, পতিতা পল্লীতে নাচের মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করছে তারা। আবার অনেকে জড়িয়ে পড়ছে যৌন ব্যবসা ও চোরাচালানিতে।
হিজড়া মুলত একটি অমানবিক অবহেলার প্রতিনাম। কেননা আমরা সভ্য সমাজের মানুষরা কোন দিনই এ জনগোষ্ঠীকে স্বীকৃতি দেইনি। তথাপিও বলতে হয় হিজড়ারাও মানুষ। আমাদের মত তাদের মৌলিক অধিকার আছে। সকরারি কর্র্তৃপক্ষকে সঠিক উদ্যোগ নিয়ে যথাযথ পুনর্বাসন করতে হবে। স্বাস্থ্যসেবার জন্য প্রয়োজনে হিজড়াদের বিশেষ ধরনের কার্ডের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এদের জন্য পৃথক শিক্ষা কার্যক্রম গ্রহণ করলে জড়তাবিহীনভাবে নিঃসঙ্কোচে শিক্ষা লাভও করতে পারবে। এবং সমাজের মূল স্রোতে ফিরে আসার জন্য শিক্ষিত হিজড়ারা নিজেরাই চেষ্টা করবে।