আজকের উন্নত বিশ্বে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী বা অন্ধদের লেখা-পড়া দেখলে কেউ আশ্চর্য হয় না। দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা ব্রেইলের মাধ্যমে লেখা-পড়া করে চ্যালেঞ্জিং পেশায় এগিয়ে আসছে। ব্রেইল হচ্ছে দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের শিক্ষার হাতিয়ার। কিন্তু কে বা কিভাবে এই ব্রেইল আবিষ্কার হয়েছে তা অনেকের কাছে অজানা। ব্রেইল পদ্ধতি যিনি আবিষ্কার করেন তিনি হচ্ছে- লুই ব্রেইল নামের এক দৃষ্টি প্রতিবন্ধী। সারা দুনিয়ার দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের আলোর পথ দেখিয়েছে। পরবর্তীতে ব্রেইলকে কম্পিউটারে মাধ্যমে বিভিন্ন সফট্ওয়ার ব্যবহার করে বিভিন্ন ভাষায় লেখার ব্যবস্থা করেছেন। ফলে অনেক ভাষায় ব্রেইল চালু রয়েছে। যা প্রিন্টারের মাধ্যমে সহজে প্রিন্ট করা হয়ে থাকে। বাংলা ভাষা লেখাতে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা বাংলা ব্রেইল করছে।

এই মহৎ ব্যক্তি লুই ব্রেইল ১৮০৯ সালের ৪ জানুয়ারী প্যারিসের নিকটবর্তী কুপভেরি নামক একটি ছোট শহরে জন্ম গ্রহণ করেন। যখন তার বয়স মাত্র ৩ বছর তখন এক দূঘর্টনার শিকার হন। এতে উভয় চোখের দৃষ্টি শক্তি কমে যায়। বাবা বহু চেষ্টা করেও প্রতিকার না পাওয়ায় দৃষ্টি শক্তি হারান।

লুইস শিক্ষার্জনের জন্য নতুন পথ অনুভব করল। এতে সে তার সাবেক স্কুলে অপ্রতিবন্ধী শিশুদের সাথে দু’বছর লেখা-পড়া করল কিন্তু শোনা ছাড়া কিছু শিখতে পারল না। ১০ বছর বয়সে প্যারিসের ‘রয়েল ইন্সটিটিউশন ফর ব্লাইন্ড ইউথ’ থেকে বৃত্তি লাভ করায় বিকল্প ব্যবস্থা খুঁজছিলো। বিশ্বের প্রথম প্রতিবন্ধীদের স্কুল প্যারিসে তাকে পাঠানো হয়। স্কুলটির পরিবেশ ছিল নোংরা। ভবন ছিলো স্যাতস্যাতে ও অস্বাস্থ্যকর এবং নিয়মাতুবর্তিতা ছিলো কড়া। ছাত্রদের সাথে অশোভন আচরণ করত এবং প্রহার করত শিক্ষকেরা। শুধু তাই নয়, সেখানে শুকনো, বাসি খাবার ও পানীয় দেওয়া হতো। এ ধরণের নিয়ম ছিল সচারচর। সেখানে ১২ বছর পার হলে স্কুল ছেড়ে কোন ফ্যাক্টরি বা প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে হতো।

১৮২১ সালে চালর্স বারবিয়ার নামে এক সৈনিক লুই ব্রেইলের স্কুল পরিদর্শনে আসে। তিনি তার আবিষ্কারের বিষয়ে মতবিনিময় করল যার নাম দিয়েছিল ‘‘নাইট রাইটিং’’ বা অন্ধকারে লেখা (১২ টি ডট বা বিন্দু দিয়ে তৈরী একটি সঙ্কেত যা কোন কথা বা শব্দ ব্যতীত সৈনিকরা যুদ্ধ ক্ষেত্রে অত্যন্ত গোপনীয় তথ্য আদান প্রদানের জন্য ব্যবহার করত)। এটি দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য সহায়ক বলে মনে করছিলেন তিনি। এটি সৈনিকের জন্য প্রমাণ করা জটিল ছিলো। সাধারণতঃ যুদ্ধক্ষেত্রে রাতের আধারে এটি ব্যবহৃত হতো। যুবক লুইস তা দ্রুত উপলব্ধি করতে পারেন যে ডট বা ছিদ্র চিহৃটি উপযুক্ত নয়। তবে একে দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য উপযোগী করা সম্ভব। কয়েকমাস নিরলস গবেষণা চালিয়ে ১২ ডটের পরিবর্তে ৬ ডট ব্যবহারের মাধ্যমে একটি আদর্শ সিস্টেম চালু করেন। তিনি কয়েক বছর পর গণিত ও সঙ্গীতের জন্য সঙ্কেত প্রবর্তন করেন। এভাবে ব্রেইল পদ্ধতিতে লেখা চালু করেন।

১৮২৭ সালে প্রথম বুক প্রকাশ করেন তিনি। তৎক্ষনাৎ দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা এই পদ্ধতি অনুধাবন করতে পারে নি। অপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিরাও তা বুঝতে পারে নি তা কিভাবে ব্যবহার বা কাজে লাগাতে হয়। এমনকি একজন প্রধান শিক্ষক একটি স্কুলে এই পদ্ধতি ব্যবহার করা নিষিদ্ধ করেন। ব্রেইল পদ্ধতি গোপনে অনেকে শিখতে থাকে। প্রতিবন্ধী ও অপ্রতিবন্ধী ছাত্র, ছাত্রীরা এর উপকারিতা ও সুফল দেখে আয়ত্ত্ব করা আরম্ভ করে। যখন সবাই বুঝতে সক্ষম হয় যে, এটি দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ও আংশিক দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের লেখা-পড়ার জন্য খুবই প্রয়োজন। তখন ধীরে ধীরে বিভিন্ন দেশে ব্রেইল পদ্ধতির প্রসার ঘটতে থাকে। ব্রেইল লেখার জন্য মোটা কাগজ ব্যবহার করতে হয়। ডটের সাহায্যে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা স্বাধীনভাবে লিখতে পারে। এটি তার জীবনদর্শাতে আলবেনিয়া থেকে দক্ষিণ আফ্রিকার কাওয়াজুলু অঞ্চলে ব্যাপক প্রচার লাভ করে। অবশেষে তিনি প্যারিসের ব্লাইন্ড স্কুলের ( তিনি পূর্বে সেখানকার ছাত্র ) শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। শিক্ষকতা পেশায় ব্যাপক সুনাম অর্জন করে প্রশংসিত হন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ছাত্রদের নিকট।

লুই ব্রেইল দুরারোগ্য ব্যাধীতে আক্রান্ত হয়ে ১৮৫২ সালে ৬ জানুয়ারী মাত্র ৪৩ বছর বয়সে দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করেন। ১৮৬৮ সালে ড. থমাস আরমিটেজ-এর নেতৃত্বে চারজন দৃষ্টি প্রতিবন্ধীর একদল প্রতিষ্ঠা করেন ‘ব্রিটিস এ্যান্ড ফরেন সোসাইটি ফর দ্যা ইমপ্রুভিং দ্যা ইমবোস্ড লিটারেচার অব দ্যা ব্লাইন্ড’। পরবর্তীতে ‘রয়েল ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব দ্যা ব্লাইন্ড (আরএনআইবি) হিসেবে পরিচিত লাভ করে। এটি ইউরোপ মহাদেশের সবচেয়ে বড় ব্রেইল প্রকাশনা। বর্তমানে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ভাষায় ব্রেইলকে নিজস্ব ভাষায় উপযোগী করে তৈরী করেছে।

লিখেছেন – আজমাল হোসেন মামুন