এটা ছিল অসম লড়াই। একদিকে সামান্য অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত ৩শ’ গেরিলা, অন্যদিকে আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত ১০ হাজার সৈন্য। আমার বিপ্লবী গেরিলারা সিয়েরা মাস্ত্রা পর্বতমালা থেকে প্রাণপণ লড়াই করে স্বৈরশাসকের অনুগত সৈন্যদের খতম করে দেয়। শত্রুর প্রতিরক্ষা ব্যূহ বিপ্লবীরা এমনভাবে ভেঙে ফেলে যে তাতে ট্যাংক, মর্টার, বাজুকা আর ৩০ ক্যালিবারের মেশিনগান ফেলেই শত্রুরা প্রাণ বাঁচাতে দিগ্বিদিক ছুটতে থাকে।’ এক আত্মজীবনীতে কিউবার নন্দিত নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রো লিখেছেন, মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ তাকে হত্যার জন্য ৬৩৪ বার চেষ্টা করেছে। কিন্তু প্রতিবারই তিনি বেঁচে গেছেন।

ক্যারিবিয়ান সাগরের দ্বীপরাষ্ট্র কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রো তার আগুনঝরানো বিপ্লবের দিনগুলো নিয়ে আত্মজীবনী ‘দি স্ট্যাটেজিক ভিক্টোরি’তে ১৯৫৯ সালে বাতিস্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধজয়ের কাহিনী বর্ণনা করেছেন। ২৫টি অধ্যায়ে বিভক্ত ৮৯৬ পৃষ্ঠার স্পেনিশ ভাষায় রচিত এ বইয়ের নাম ‘লা ভিক্তোরিয়া এস্ত্রেতেজিকা’, ইংরেজিতে ‘দি স্ট্র্যাটেজিক ভিক্টোরি’। বাংলায় বইটির শিরোনাম হতে পারে ‘কৌশলগত বিজয়’। সূত্র : ইন্টারনেট

গত সোমবার হাভানা ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সেন্টারে কিউবার এ রহস্যময় গেরিলা নেতা বইটির মোড়ক উন্মোচন করেন। প্রাথমিকভাবে সাড়ে ৩ হাজার বই ছাপানো হলেও শিগগির আরও ৫০ হাজার বই বাজারে ছাড়া হবে বলে কিউবার মিডিয়া জানিয়েছে। বইটি নিয়ে বিশ্বব্যাপী সব মিডিয়ায় খবর প্রচারিত হচ্ছে।

১৯৫৯ সালে মার্কিন সমর্থিত স্বৈরশাসক ফুলজিনেসিও বাতিস্তার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ক্যাস্ট্রোর গেরিলাদের উপমাবিহীন লড়াই ও বিজয়ই বইটির মূল উপজীব্য। সম্প্রতি স্মৃতিচারণমূলক বই লেখার ঘোষণা দিয়েছেন ব্রিটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার। তার বইয়ের নাম ‘দি জার্নি’। আগামী ২ সেপ্টেম্বর তা আলোর মুখ দেখবে। অন্যদিকে আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ ‘বুশস মেমোইরস’ নামে বই লেখার কথা ঘোষণা দিলেও তা সাড়া জাগাতে পারেনি। কিন্তু ক্যাস্ট্রো তার বইয়ের কথা জানাতেই আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠেন।

এক ঝাঁক সহযোদ্ধা আর প্রবীণ বিপ্লবী নিয়ে মোড়ক উন্মোচনকালে ক্যাস্ট্রো বলেন, ‘সেইদিনের অজানা কথাগুলো জানিয়ে দেয়ার মাঝে রয়েছে ভিন্ন মাপের গুরুত্ব।’কিউবায় স্বৈরাচার উত্খাতের সশস্ত্র সংগ্রামে যারা সেদিন অকাতরে বুকের তাজা খুন ঢেলেছেন, তাদের অমর-অমলিন স্মৃতির উদ্দেশে বইটি নিবেদন করেছেন বিংশ শতাব্দীর অসাধারণ গেরিলা ও রাষ্ট্রনেতা। তার ভাষায় ‘এটা ছিল অসম লড়াই। একদিকে সামান্য অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত ৩শ’ গেরিলা, অন্যদিকে উন্নত অস্ত্রসজ্জিত ১০ হাজার সৈন্য।’

২০০৬ সালে শারীরিক অসুস্থতার কারণে তার দেহে অস্ত্রোপচার হয়। এ সময় ছোট ভাই রাউল ক্যাস্ট্রোর হাতে সাময়িকভাবে ক্ষমতা ছেড়ে দেন কিউবার এ মহানায়ক। পরে ২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমতা ত্যাগ করেন। আর ২০০৯ সালের জুন মাস থেকে তিনি বইটি লেখায় হাত দেন। তবে এটা তার শেষ বই নয়। কিউবার বিপ্লবের পুরো ইতিহাস লেখার কথা ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। বিপ্লবী গেরিলাদের পাল্টা আঘাতের কাহিনীগুলো তাতে প্রাধান্য পাবে।

বইয়ের শিরোনাম নিয়ে দ্বিধায় ছিলেন ক্যাস্ট্রো। প্রথমে ঠিক করেছিলেন শিরোনাম দেবেন ‘বাতিস্তার শেষ হামলা’ অথবা ‘তিনশ যেভাবে ১০ হাজারকে হারায়’। পরে শিরোনাম পাল্টে রাখলেন ‘কৌশলগত বিজয়’। এ শিরোনামের যৌক্তিকতা তিনি লিখেছেন বইটিতে, ‘টানা ৭৪ দিনের রক্তরাঙা লড়াইয়ের পর পরাক্রমশালী শত্রুর পরাজয় এটাই প্রমাণ করেছে, যুদ্ধটি শেষ পর্যন্ত কৌশলগত লড়াইয়ের দিকে মোড় নিয়েছে। লড়াইয়ের এ হারই স্বৈরশাসকের ভাগ্য নির্ধারণ করে দিল।’

ক্যাস্ট্রো ১৯৫৯ সালের পহেলা জানুয়ারিতে বাতিস্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলাদের এ অবিশ্বাস্য জয়কে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর সঙ্গে তুলনা করেছেন। বইটিতে আত্মজীবনীর হাল্কা রেখাপাত যে রয়েছে, তার প্রমাণ মেলে নিচের লাইনগুলোতে, ‘আমার শৈশব, কৈশোর আর যৌবনকাল নিয়ে উত্তরহীন হাজারো প্রশ্নের মুদ্রিত জবাবের অপেক্ষায় থাকতে চাইনি। বিশেষত জীবনের কোন পর্বটি আমাকে বিপ্লবী বানাল, সশস্ত্র যোদ্ধা বনতে ভূমিকা রাখল, তা আমি জানাতে চাই।’

তবে বইটির বেশিরভাগ জায়গা জুড়ে রয়েছে কীভাবে বিপ্লবী গেরিলারা সিয়েরা মাস্ত্রা পর্বতমালা থেকে স্বৈরশাসকের অনুগত যোদ্ধাদের প্রাণপণ লড়াইয়ের মাধ্যমে খতম করে দিয়েছে। শত্রুর প্রতিরক্ষা ব্যূহ ভেঙে অস্ত্র উদ্ধারের বুক হিম করা কাহিনীগুলো এতে ঠাঁই পেয়েছে। ট্যাংক, মর্টার, বাজুকা আর ৩০ ক্যালিবারের মেশিনগান ফেলেই শত্রুরা কীভাবে প্রাণ বাঁচাতে দিগ্বিদিক ছুটেছে, তার প্রাণবন্ত বর্ণনা দিয়েছেন এ মহান বিপ্লবী নেতা। অসাধারণ রণকৌশলের কারণে কেউ কেউ তাকে আধুনিক যুগের জুলিয়াস সিজারও বলেন। বইতে লড়াইয়ের দিনগুলোর কথা ফুটিয়ে তুলতে তিনি মানচিত্র, ছবি আর ডায়াগ্রামের আশ্রয় নিয়েছেন।

চার দশকের বেশি সময় ধরে কিউবার বিরুদ্ধে আমেরিকার অর্থনৈতিক অবরোধই ফিদেল ক্যাস্ট্রোকে আধুনিক যুগের রহস্যময় রাষ্ট্রনায়ক বানিয়ে রেখেছে। ব্রিটেনের রানী ভিক্টোরিয়া এবং থাইল্যান্ডের রাজা ভূমিবলের পরই সবচেয়ে বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় ছিলেন কিউবার এ বিপ্লবী নেতা। তিনি জোরগলায় দাবি করেন, সিআইএ তাকে হত্যার জন্য ৬৩৪টি উদ্যোগ নিলেও প্রতিবারই তিনি বেঁচে গেছেন। ১৯৬০ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে টানা ৪ ঘণ্টা ২৯ মিনিট ভাষণ দিয়ে তিনি গিনেস রেকর্ড বুকে নিজের নামটি লেখান। তবে ১৯৮৬ সালে হাভানায় তৃতীয় কমিউনিস্ট পার্টি কংগ্রেসে টানা ৭ ঘণ্টা ১০ মিনিট ভাষণ দিয়েছেন বলে তার রেকর্ড রয়েছে। চুরুটপ্রেমী এ গেরিলা নেতা ১৯৮৫ সালে চুরুট ত্যাগের পর বলেছেন, ‘সিগারেটের বাক্সের সর্বোত্তম ব্যবহার হচ্ছে, ওটা শত্রুকে দান করে দেয়া।’