হতে পারে ভালোবাসার বিয়ে। আবার হতে পারে পারিবারিকভাবে আনুষ্ঠানিক বিয়ে। অনেক সময় দুটোই একসঙ্গে হয়। বিয়ে যে ধরনেরই হোক, প্রশ্ন হচ্ছে বিয়ের পাত্রপাত্রী দুজনই সুস্থ তো? শারীরিক অসুস্থতা চোখে দেখা যায়, কিন্তু মানসিক সুস্থতা নিশ্চিত করা কতটুকু প্রয়োজন, এ বিষয়ে আমাদের সমাজ এখনো অনেক পিছিয়ে আছে।

বিয়ের আগে অনেক কিছু জেনে নেওয়া হয়: যেমন—পাত্রপাত্রীর বয়স, শিক্ষাগত যোগ্যতা, উচ্চতা, গায়ের রং, আচার-ব্যবহার, অর্থনৈতিক অবস্থা, বংশপরিচয়, চাকরি এমনকি কত টাকা বেতন পায় ইত্যাদি। কিন্তু এগুলোর সঙ্গে অত্যন্ত জরুরি যে বিষয়টি জেনে নেওয়া প্রয়োজন তা হচ্ছে, পাত্রপাত্রীর মানসিক ভারসাম্য কতটুকু আছে, সে কোনো মানসিক রোগ বহন করছে কি না। কেননা, বিয়ের পর সংসার আদৌ টিকবে কি না এবং পরবর্তী বংশধর সুস্থ হবে কি না, এ বিষয়গুলো নির্ভর করছে পাত্রপাত্রীর এই জরুরি বিষয়গুলোর ওপর।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বিয়ের আগেই পাত্রপাত্রীর মানসিক অবস্থা সম্পর্কে কীভাবে বা কতটুকু জানা-বোঝা সম্ভব? খুব চরম পর্যায়ে মানসিক রোগী ও প্রতিবন্ধী ছাড়া অধিকাংশ মানসিক রোগীর চেহারা দেখে কখনোই বোঝা সম্ভব নয়, সে মানসিক রোগী। বরং কিছু মানসিক রোগী আছে (যেমন—পারসোনালিটি ডিজঅর্ডার) যারা খুব আকর্ষণীয় চরিত্র দেখিয়ে বেড়ায়, ফলে অন্য কারও পক্ষে কিছুতেই বুঝে ওঠা সম্ভব নয়। এ ছাড়া অধিকাংশ মানসিক রোগীকে চোখে দেখে বা ঘণ্টা খানেক কথা বলে অথবা মাস খানেকের পরিচয়ে কখনোই তাঁর রোগ সম্পর্কে বুঝে ওঠা সম্ভব নয়। অন্যদিকে পাত্রপাত্রীর পরিবার এই তথ্য অন্য পক্ষকে জানাতে চায় না। কেননা, এতে বিয়ে কখনোই হবে না।

আমাদের সমাজের একটি আশ্চর্য দিক হচ্ছে, মানসিক সমস্যা যদি পুরুষের হয়, তবে সেটা বিয়ের ক্ষেত্রে কোনো বাধা হিসেবে মনে করা হয় না। বরং মনে করা হয়, বিয়ে করে বউ নিয়ে এলে সে আরও সুস্থ হয়ে যাবে, তার দেখাশোনার জন্য একটা স্থায়ী লোকের ব্যবস্থা হবে। তার শারীরিক চাহিদা, মনোরঞ্জন—সবকিছুর সুবন্দোবস্ত হবে। অনেক সময় এই উদ্দেশ্যে দরিদ্র পরিবারের কোনো মেয়েকে বিয়ের পাত্রী হিসেবে বাছাই করা হয়, যেখানে মেয়েটি ভরণপোষণের বিনিময়ে মানসিক রোগীকে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করে। এমনকি মেয়েটির পরিবারই এ সুযোগ গ্রহণ করে আগ্রহের সঙ্গে। এটি আমাদের দরিদ্র সমাজের চিত্র বা ফল। কিন্তু মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তিটি যদি হয়ে থাকেন কোনো নারী, তবে তাঁর কোনো সমাধানের দিকে যাওয়াই সম্ভব হয়ে ওঠে না।

যেমন: পাত্রী মানসিক রোগী জানলে পাত্রপক্ষ অবশ্যই পালিয়ে যাবে। না জানিয়ে বিয়ে দেওয়াটা অনেকটা প্রতারণা করা হয়ে যায়, তা ছাড়া না জানিয়ে বিয়ে দেওয়ার ফল কখনোই ভালো হয় না। হয় মেয়েটিকে পরবর্তী সময়ে তালাকপ্রাপ্ত হতে হয়, সতিনের সংসারে দুর্বিষহ জীবন মেনে নিতে হয় অথবা পাত্রীর পরিবারকে অপমান-অপদস্থ হওয়াসহ বিষয়টি মামলা পর্যন্ত গড়ায়। আবার বিয়ে না দিয়ে ওই কুমারী মেয়ের দায়িত্ব মা-বাবা কার ওপর রেখে যাবেন? একে পৃথিবীতে রেখে অসহায় মা-বাবা মৃত্যুর কথা ভাবতেও ভয় পান।তাহলে কি মানসিক সমস্যা থাকায় মেয়েটির কোনো দিন বিয়ে হবে না?

এখন পর্যন্ত যে অবস্থাটি আমাদের সমাজে চালু আছে, সেটি দুই রকম—এক. না জানিয়ে বিয়ে দিয়ে দেওয়া, পরবর্তী সময়ে যা হওয়ার হবে, এ ধরনের চিন্তাভাবনা। দুই. জানিয়ে এবং বিশেষ কিছু শর্ত বা উপঢৌকনের বিনিময়ে, যেমন: পাত্রকে বাড়ি/অ্যাপার্টমেন্ট, চাকরি, গাড়ি, ব্যাংক-ব্যালান্স, থাকা-খাওয়ার অবারিত সুযোগ, এমনকি পাত্রের পরিবারবর্গের কোনো রকম স্থায়ী বন্দোবস্ত করে দেওয়া। সাধারণত, সমাজের বিত্তবান পরিবারে এই প্রক্রিয়া চালু আছে।

মানসিক রোগিণীর বিয়ে অবশ্যই দেওয়া যাবে, তবে সে ক্ষেত্রে কিছু বিষয় লক্ষ রাখা প্রয়োজন। যেমন: তাকে অবশ্যই চিকিৎসা করাতে হবে। চিকিৎসায় সে যথেষ্ট সুস্থ-স্বাভাবিক হওয়ার পর মানসিক চিকিৎসক যখন বলবেন, তখন তার বিয়ের আয়োজন করা। তবে চিকিৎসক বলার আগেই নয়, এমনকি চিকিৎসককে না জানিয়েও নয়। বিয়ের পাত্রপক্ষকেও জানিয়ে বিয়ে দেওয়া উচিত, যদিও বিষয়টি অনেকটা অসম্ভব। তার পরও পরবর্তী সময়ে কোনো খারাপ ফলের দিকে ঘটনা যাওয়ার চেয়ে জানিয়ে দেওয়াটা শ্রেয়। তবে বিয়ের পরও পাত্রীর চিকিৎসা চালু রাখতে হবে আগের মতো।

কেননা, বিয়ের পর বিশেষ কিছু চাপ সৃষ্টি হয়; যেমন, স্বামীর সঙ্গে শারীরিক ও মানসিক অভিযোজন, সাংসারিক কাজকর্ম, শ্বশুরবাড়ির লোকজনের সঙ্গে অভিযোজন—এই চাপগুলোর কারণে রোগিণীর সমস্যা বাড়তে পারে। সে কারণে বিয়ের পরও মনোরোগ চিকিৎসকের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করা, নিয়মিত ওষুধ সেবন করা, সংসারকর্মে সাহায্য করা, স্বামী ও অন্যদের ভালো ব্যবহার ও সহযোগিতা ইত্যাদি অবশ্যই চালিয়ে যেতে হবে।

-সংগৃহীত