হেমন্ত এসে গেল। বদলে যাওয়া আবহাওয়া জানান দিচ্ছে সেটা। এখন রাতের হাওয়ায় হিমের পরশ। ধীরে ধীরে সরে যাবে তুলোর মতো সাদা মেঘের ভেলা। কুয়াশার ঘনঘোরে সকাল-সন্ধ্যায় মুখ লুকোবে আকাশ। আচমকা বৃষ্টি-বাদলের হানা দেওয়ার পালা ঘুচে যাবে দিনে দিনে। তার বদলে রাতভর ঝরবে শিশির। দিনগুলো ছোট হয়ে আসবে। সূর্যের খরতাপও ম্লান হবে ক্রমেই। বর্ষায় টইটম্বুর হয়ে উঠেছিল যেসব খালবিল, জলাশয়; সেসবের পানি নামতে শুরু করেছে। সেই সঙ্গে গ্রামবাংলায় ফিরে এসেছে এক চিরচেনা আনন্দঘন দৃশ্য।

বালক-কিশোর থেকে শুরু করে সব বয়সের উৎসাহীদের দল পলো, ঠেলাজাল ইত্যকার সরঞ্জামে সজ্জিত হয়ে মহোৎসাহে নেমে পড়েছে বিল-ঝিলে। শুধু মাছ ধরাই নয়, পাতা চিনে চিনে ডুব দিয়ে সুস্বাদু শালুক তুলে আনা, সবাই মিলে হইহল্লা করে পানিতে সাঁতরে, দাপিয়ে দুই চোখ রক্তজবার মতো লাল করে ফেলা—সে এক মহা-আনন্দের আয়োজনই বটে। দিনে দিনে পানি যতই শুকিয়ে আসবে, আনন্দযজ্ঞেও যোগ হবে নতুন মাত্রা।

পথের পাশের খাল, নয়ানজুলি, এঁদো ডোবা সেচে মৎস্যশিকারের আরেক পর্ব শুরু হবে তখন। ডোঙা, সেনি, বালতি প্রভৃতি দিয়ে পানি সেচে কাদা ঘেঁটে পুঁটি, টেংরা, দারকিনা, শোল, টাকি, মাগুর, শিং, কই ধরার যে বিমল আনন্দ বাঙালির জীবনে, বঙ্গে যারা জন্মেনি তারা কি তা কোনো দিনই অনুভব করতে পারবে? শুধু ভিনদেশিরাই বা কেন, হাল আমলে প্রকৃতির ন্যূনতম ছোঁয়া ছাড়া শহুরে পরিবেশে যেসব শিশু বেড়ে উঠছে আজকের বাঙালির ঘরে ঘরে, দুফোঁটা বৃষ্টির পানি চাঁদিতে পড়লেই যাদের জ্বর আসে, তারাও তো বঞ্চিত বাংলার কাদা-জল গায়ে মেখে মাছ ধরার এই পরমানন্দ থেকে!

মাছে-ভাতে বাঙালির জীবনে মাছ এখন প্রায় দুর্লভ। বিল-ঝিল, ডোবা-পুকুর সব ভরাট হয়ে যাচ্ছে, দখল হয়ে যাচ্ছে জলজ্যান্ত নদীও! মাছের প্রাকৃতিক আবাস ক্রমহ্রাসমান। তার ওপর শস্য উৎপাদনে ব্যবহূত বিপুল পরিমাণ রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহারও মৎস্যকুলের অস্তিত্ব-সংকটের অন্যতম প্রধান কারণ। অভ্যন্তরীণ জলাভূমির মাছ তাই দিনে দিনে দুর্লভ হয়ে উঠছে। বাংলাপিডিয়ার তথ্যে দেখা যাচ্ছে, আমাদের দেশের অভ্যন্তরীণ জলাশয়ে একসময় ছিল ২৬৭ প্রজাতির মাছ। এর মধ্যে ১২ প্রজাতির মাছ অতিবিপন্ন, ২৪ প্রজাতি বিপন্ন এবং ১৪ প্রজাতি বিপন্নপ্রায়। অবস্থা তেমন ভালো নয়, এমন প্রজাতির সংখ্যা ৬৭। ২৬৭ প্রজাতির মাছের মধ্যে এখন মাত্র ১৪৬ প্রজাতির মাছ ভালো অবস্থায় আছে।

এর মধ্যে বেশির ভাগই ‘ভালো আছে’ চাষ করা হচ্ছে বলে। অতিবিপন্ন প্রজাতির মাছের মধ্যে আছে: তিলা শোল, গজার, তেলো টাকি, কুচিয়া, তারাবাইম, বামোশ, মহাশোল, কাইক্কা ইত্যাদি। এ ছাড়া যে মাছ নিয়ে আমাদের গর্ব এবং গল্পের শেষ নেই, সেই ইলিশও সরে যাচ্ছে গভীর সমুদ্রের দিকে। পদ্মা এখন বলতে গেলে ইলিশশূন্য। আমাদের সাগরে পাওয়া লোনাপানির মাছ আছে ৪৪২ প্রজাতির। তবে এসব মাছ দেশের সব অঞ্চলে সব সময় পাওয়া যায় না। চাঁদা, ভেটকি, লাক্ষা, পোয়া, টুনার মতো কিছু মাছ ছাড়া অন্যগুলো তেমন জনপ্রিয়ও নয়। যেসব মাছের জন্য বাঙালিকে অনেকেই বলেন ‘মছলিখোর’ সেগুলো মূলত মিঠাপানিরই মাছ।

খাল-বিল-নদীর মুক্ত জলাশয়ের মাছের অস্তিত্ব বিপন্ন, তাই মাছ ধরার আনন্দও এখন বাঙালির জীবন থেকে বিলীন হওয়ার পথে। শৈশব-কৈশোরে বিলে-ঝিলে দাপিয়ে মাছ ধরার আনন্দ অনেকের জীবনেই পড়ন্ত বেলার এক ধূসর স্মৃতি। আগামী দিনের বাঙালিকে এর কিছুটা ধারণা দিতে হলেও দেশের নদ-নদী জলাশয়গুলোকে আগলে রাখা প্রয়োজন। আমরা কি তা পারব?

তথ্যঃপ্রথম আলো