জলাভূমি ভরাট করে কিংবা দুর্বল মাটির উপর নির্মাণ করায় ঢাকায় ভবন হেলে পড়ার মতো ঘটনা ঘটছে বলে মত দিয়েছেন ভূ-তত্ত্ববিদ ও প্রকৌশলীরা।

সেই সঙ্গে নীতিমালা না মেনে ভবন তৈরি ও প্রকৌশলগত নির্মাণ ত্র”টিকেও সা�প্রতিক আতঙ্কের কারণ হিসেবে চিহিৃত করেছেন বিশেষজ্ঞরা।

কয়েকদিনের ব্যবধানে বেগুনবাড়ি ও নাখালপাড়ায় ভবন হেলে যাওয়া আর শান্তিনগরের ভবনে ফাটলের ঘটনায় এই বিষয়টি এখন আলোচনায়।

তবে ভূ-তাত্ত্বিক ‘পরীক্ষা’ না করেই ভবন হেলে যাওয়া কিংবা ভবনে ফাটলের বিষয়ে মতামত দিয়ে আতঙ্ক না ছড়ানোর জন্য অনুরোধ জানিয়েছেন বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের সাবেক অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী।

ঢাকাকে ‘অপরিকল্পিত’ নগরী হিসেবে উল্লেখ করে তিনি সরকারকে দ্রুত প্রস্তাবিত রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের ‘ডিটেইল এরিয়া প্ল্যান অব ঢাকা সিটি’ বাস্তাবয়নের আহ্বান জানান।

মঙ্গলবার রাত পৌনে ১১ টার দিকে রাজধানীর তেজগাঁওয়ে বেগুনবাড়ির পোস্ট অফিস গলির ১৮/বি নম্বর বাড়িটি ধসে পাশের কয়েকটি তিন তলা টিনশেড বাড়ির ওপর পড়ে। ওই এলাকাতেই গত শুক্রবার আরো একটি ভবন হেলে যায়। শনিবার হেলে পড়ে নাখালপাড়ার একটি পাঁচতলা ভবন।

অপরিকল্পিত ভবন নির্মাণের খেসারত ও ত্রিমাত্রিক মডেল প্রযুক্তি

রাজধানীর বেগুনবাড়িতে যে ভবনটি ধসে পড়েছে তার কারণ হিসেবে বাংলাদেশ ভূ-তাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তরের পরিচালক (নগর প্রকৌশল ও ভূতত্ত্ব) এটিএম আসাদুজ্জামান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অনুমোদন না নিয়ে বেগুনবাড়ি খালের উপর দুর্বল মাটিতে পাঁচ তলা ভবন নির্মাণ করায় তা ধসে পড়ে।”

নগরায়নে জনগণের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো না হলে ভবিষ্যতে ঢাকা মহানগরী মৃত্যুপুরীতে পরিণত হতে পারে বলেও আশঙ্কা করেন আসাদুজ্জামান।

রাজধানী ঢাকার নিচু এলাকার বহুতল ভবনগুলোকে সম্ভাব্য বিপর্যয় থেকে রক্ষার জন্যে ভূমির ত্রিমাত্রিক মডেল প্রযুক্তি প্রয়োগ করার সুযোগ তৈরি হয়েছে বলেও জানান আসাদুজ্জামান।

গত বছর ‘বিল্ডিং গ্রাউন্ড ইনফরমেশন সিস্টেম ফর ঢাকা সিটি (বিজিআইএস)’ এর উপর দুই বছর মেয়াদী একটি প্রকল্প শেষ করা হয়। এতে বাড্ডা এলকার ৬০ বর্গ কিলোমিটার এবং কাকরাইল এলাকার ১৮ বর্গ কিলোমিটার এলাকার ভূমির উপাত্ত বিশ্লেষণ করা হয়।

আগামীতে বৃহত্তর ঢাকার এক হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে কার্যক্রম হাতে নেওয়া হবে জানিয়ে ওই প্রকল্পের পরিচালক আসাদুজ্জামান বলেন, “নতুন এই প্রযুক্তির সহায়তায় নির্মাণ ভূমির বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী স্থাপনা নির্মাণ সহজ হবে।”

ইতিমধ্যে বাড্ডা এলাকায় নিচু জায়গা ভরাট করে নির্মিত স্থাপনাকে রাজধানীর সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচনা করছে বিজিআইএস।

আসাদুজ্জামান জানান, ঢাকা মহানগরী বিশ্বের পরিবেশগত ঝুঁকিপূর্ণ শহরগুলোর অন্যতম। এই অবস্থায় ‘ভুমির ত্রিমাত্রিক মডেল’ পরিকল্পিত নগরায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। নির্মাণ ভূমির বৈশিষ্ট্য বুঝে স্থাপনা নির্মাণের ব্যাপারে জনসচেতনতা বাড়ানো গেলে কমবে ভূমিকম্প, ভূমিধস ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা।

মাঝারি ধরনের ভূমিকম্প হলেই ঢাকায় ধ্বংসযজ্ঞ নেমে আসবে-এ সতর্কতা উচ্চারণ করে এটিএম আসাদুজ্জামান বলেন, বিশেষ করে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা ও সিলেটে যেভাবে অপরিকল্পিত স্থাপনা গড়ে উঠছে� তাতে এ প্রযুক্তির কোনো বিকল্প নেই।

জনসাধারণের জন্য বিনামূল্যে তথ্য দেওয়া হবে উল্লেখ করে তিনি জানান, উচ্চ প্রযুক্তির সফটওয়্যার ব্যবহার করে প্রকল্পটিতে প্রায় একশ’ ফুট (৩০ মিটার) গভীর নির্মাণ ভূমির সহজবোধ্য ত্রিমাত্রিক উপাত্ত দিয়ে করণীয় সুপারিশমালা ও দিকনির্দেশনা তুলে ধরা হয়। এতে ঢাকা মহানগরীর ভূগর্ভস্থ প্রতিটি স্তরের ভূতাত্ত্বিক ও ভূ-প্রাযুক্তিক বৈশিষ্ট্য, গঠন ও প্রকৃতি প্রতিফলিত হবে।

তিনি আরও বলেন “নির্মাণভূমির এই ত্রিমাত্রিক উপাত্ত ও সুপারিশমালা ব্যবহার করে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা পরিহার করে কম ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বসবাসের বিকল্প পরিকল্পনা করা যাবে।”

অতিঝূঁকিপূর্ণদের তালিকা শিগগির

ভবন হেলে যাওয়া কিংবা ফাটলের বিষয়ে আজকাল বেশি অভিযোগ রাজউক-এর কাছে আসছে বলে জানান রাজউক-এর পরিকল্পনা শাখার পরিচালক আবদুল মান্নান।

তিনি বলেন, “এ ধরনের অভিযোগ নতুন কিছু নয়। ফাটল বা হেলে যাওয়ার ঘটনায় জনমনে এক ধরনের ‘প্যানিক’ তৈরি হচ্ছে। তবে যথাযথ নিয়মে তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে অভিযোগগুলোর বিষয়ে মত দেওয়া যাবে।”

রাজউক-এর চিহ্নিত করা ৫ হাজার ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকায় স�প্রতিক অভিযুক্ত ভবনগুলোও রয়েছে বলে জানান এই রাজউক কর্মকর্তা।

আবদুল মান্নান জানান, রাজউক চেয়ারম্যান প্রাথমিকভাবে চিহ্নিত তালিকা থেকে অতিঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলোর তালিকা করার জন্যে প্রধান প্রকৌশলীর নেতৃত্বে ১০ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।

অধ্যাপক জামিলুর চৌধুরী জানান, ঢাকা ঝুঁকিপূর্ণ ও অপরিকল্পিত নগর হলেও তা থেকে বেরিয়ে আসতে সরকারকে যথাযথ পরিকল্পনা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। সরকারের গঠিত কমিটির এই আহ্বায়ক জানান গত ১২ এপ্রিল ‘ডিটেইল এরিয়া প্ল্যান’এর প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে।

জামিলুর রেজা চৌধুরী জানান, পুরান ঢাকার মতো আবাসিক এলাকায় রাসায়নিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোকে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া, জলাভূমি ভরাট করে ভবন নির্মাণ বন্ধসহ বেশ কিছু সুপারিশ প্রতিবেদনে করা হয়েছে।