গত পাঁচদিন ধরে শরীরটা ভাল যাচ্ছে না টিনার। অন্যদিনের মত বিকেলটা আজ পুতুল খেলে কাটায়নি সে। সর্দি জ্বরে কাবু হয়ে গেছে বেচারী। সকাল থেকেই মাথার ক্যান ক্যানে ব্যথাটা বেড়ে যাওয়ায় স্কুলেও যাওয়া হয়নি। আজ শাম্মি আপির বিয়ে। স্কুল শেষে বিয়ে বাড়িতে যাওয়া যেত, যাওয়া হচ্ছেনা। মনটাও খারাপ। আজ গোসল করা হয়নি। ঠান্ডা লেগে যাবে বলে গোসলে মায়ের এ নিষেধাজ্ঞা জারী। দুপুরে ঠিক মত ভাত ও খেতে পারলো না টিনা। ঘুমিয়ে পড়েছে এই পড়ন্ত দুপুরে।

অদ্ভূৎ শব্দে ঘুম ভাংলো টিনার। চোখ মেলে শব্দটা ঠাহর করার চেষ্টায় উঠে বসলো বিছানায়। সর্দিতে মাথাটা তখনো ভার হয়েই আছে। বিছানা থেকে পা ঝুলিয়ে বসে চপ্পল জোড়া খুঁজতে গিয়ে চোখে পড়লো লাল পিঁপড়েদের এক বিরাট লম্বা সারি! টিনার খাটের নীচ থেকে শুরু করে অনেক দূর পর্যন্ত গেছে তাদের অভিযাত্রা। লক্ষ্যনীয় ব্যাপার যেটা সেটা হলো- পিঁপড়েদের প্রত্যেকের মুখ আর মাথায় সাদা সাদা কি সব লাগিয়ে যেন সেজেছে। বেশ উৎসুক হলো টিনা। বিছানা ছেড়ে পিঁপড়ের সারিটাকে অনুসরণ করলো। দেখলো করিডোরে যাওয়ার পথের দরজাটার ডান কোণ ঘেষে মেঝের ফাটল দিয়ে পিল্‌-পিল্‌ করে ঢূকে পড়ছে পিঁপড়েরা এক এক করে।
খাটের নিচ থেকে ম্যাচের বাক্সে পুরে রাখা পুতুলের খাদ্য রসদ- পনির, বিস্কিট আর মিমি চকোলেটের গুঁড়ো নিয়ে এলো পিঁপড়েদের জন্য। সারি থেকে দল ভেঙ্গে আসা কতগুলো পিঁপড়ে জড়ো হ’লো ম্যাচ বাক্সটিকে ঘিরে, তারপর পিঁ-পিঁ শব্দ করে ওদের নিজেদের মধ্যে কি সব যেন বল্ল। পিঁপড়েদের সুর নকল করে টিনাও উচ্চারণ করলো- পিঁ পিঁ। অমনি ঘটলো অলৌকিক এক কান্ড!
টিনা তার মাথায় প্রচন্ড এক ঘূর্ণি অনুভব করলো,সমস্ত শরীর যেন পাখার মত ঘুরছে। ঘূর্ণি একসময় থেমে যেতেই নিজেকে দেখতে পেলো পিঁপড়েদের সারিতে। পিঁপড়ে দলের সাথে সামনের দিকে হাঁটতে লাগলো টিনা।

গর্তের কাছে পৌঁছুতেই লাফ দিয়ে গর্তে ঢুকে গেলো টিনা। অবাক করা কান্ড! এ যে এক বিয়ে বাড়ি! ঐ তো পিকি আর পিনি কে সে দেখতে পাচ্ছে! পাতার মঞ্চে বর-কনে বেশে বসে আছে পিকি আর পিনি। মনে মনে ভিষণ লজ্জা পেল টিনা। বিয়েতে সে কি না খালি হাতে এলো! এর ওর চোখ ফাঁকি দিয়ে গর্ত থেকে বেড়িয়ে এলো টিনা। অহ! বাইরে এত আলো! বারান্দা পেরিয়ে উঠোনে নেমে গন্ধরাজ গাছটার দিকে এগুলো সে। গাছটিকে বেশ উঁচু মনে হলো টিনার। গাছের কান্ড বেয়ে, শাখায় ঝূলে অবশেষে টিনা পৌঁছুতে পারলো একটা গন্ধরাজ ফুলের কাছে। কয়েকটি গন্ধরাজ ফুলের পাপড়িকে একত্রে খেঁজুর কাঁটা দিয়ে গেঁথে-গেঁথে বানালো দারুণ একটা ফুলের পাল্‌কি। ছোট্ট একটা টীপ এর কৌটোয় ভরে নিলো কিছু পরাগ রেণু। হলুদ পরাগরেণু গুলো গালে মাখলে পিনিকে নিশ্চই দারুণ লাগবে! ভেবে গালে টোল ফেলে হাসলো টিনা।

গর্তের কাছে যেতেই অনেকগুলো লাল পিঁপড়ে এগিয়ে এলো টিনার দিকে। পিঁ-পিঁ-পিঁ। এবার টিনা ওদের কথা বুঝতে পারলো। ডাগর চোখের লাল পিঁপড়েটার সাথে হাসি মুখে এগিয়ে গেলো সে পিকি আর পিনির মঞ্চের দিকে। ওদের তখন রাত্রী ভোজ চলছে। শিরিষ গাছের ছোট্ট-ছোট্ট অণূপত্রে পিঁপড়েদের দেয়া হয়েছে ভাজা আরশোলার পাখা অথবা পায়ের রোষ্ট। আস্ত একটা আরশোলার রোষ্ট দেয়া পিকি আর পিনির সামনে।তাদের ঘিরে বসে আছে নানান প্রজাতির পিঁপড়েরা। উঁই পোকারাও এসেছে অতিথি হয়ে। ওদের মাঝে কিছু বিদেশী অভ্যাগতদের দেখতে পেলো টিনা। তাদের মধ্যে কাল পিঁপড়েটার দুষ্টূমী চোখ এড়ালো না তার। জগ এর শরবত প্রায় সবটুকুই খেয়ে ফেলল কালো পিঁপড়েটা। তাকে শাসন করতে তেড়ে এলো কালো পিঁপড়ের মা। বেশ ভারী শরীরের মা পিঁপড়েটার হাঁটার গতি খুব শ্লথ হলেও রাগ বেশী-ই। ছেলেটাকে নিয়ে বাইরে চলে গেলো মা কালো পিঁপড়েটা।
চিকণ মোলায়েম ঘাসের গয়নায় পিনিকে আজ অপরুপা লাগছে! পিকি পড়েছে শুকনো ঘাসের আঁশ দিয়ে তৈরী টোপর। দু’জনের গায়েই দামী আঁশের কাপড়। পাখাওয়ালা পিঁপড়েরা এ কাপড় বানিয়ে এনেছে। পিনি হাসি মুখে পিকির কানের কাছে ফিস ফিসিয়ে বলছিলো টিনার কথা। ওদের সুখী-সুখী মুখগুলো দেখতে খুব ভালো লাগছিলো টিনার।

ফুলের পালকিটা ওদের সামনে রাখতেই উপস্থিত সবাই বিশ্ময়ে তাকিয়ে রইলো, আর সেই সাথে গন্ধরাজ ফুলের পাপড়ির সৌরভে ভরে উঠলো চারপাশ। বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষে পিকি আর পিনি ফুলের পাল্‌কিটায় এসে বসলো। সবাইকে অনুরোধ করলো টিনা পিঁ-পিঁ চিঁ-চাঁ বলে; মানে আজ রাতটা পিকি আর পিনি টিনার নির্ধারিত সুন্দর জায়গায় বাসর যাপন করবে আর পরদিন বিকেলে শ্বশুরবাড়ী যাবে পিনি। যদিও পিকির মা এ প্রস্তাবে প্রথমটায় রাজী হলেন না, পরে সবাই এতে সায় দিলেন পিকি ও পিনির আগ্রহ দেখে। ওদের নিয়ে টিনা গর্ত থেকে বেড়িয়ে এলো।

টিনা তার খাটের পাশ ঘেষা জানলাটার কার্নিশে রাখা মানিপ্ল্যান্ট গাছ এর টবটায় পালকিটা থামালো। গাছের গোড়ায় টবের মাটিতে ছোট্ট দু’টো চেয়ার পেতে বসতে দিলো- পিকি আর পিনিকে। এই চেয়ার দু’টো টিনা বানিয়েছে সিগারেটের বাক্সের ভেতরকার রাংতা মুড়ে। এ জানলাটা দিয়ে রাতে চাঁদের আলো এসে টিনার মুখের উপড় পড়ে। প্রতি রাতে একটু একটু করে চাঁদণি ধার করেই তো টিনা অমন রূপসী লক্ষী মেয়ে!
জানলাটার ওপাশ থেকে ফুলের ঘ্রাণ ভেসে আসছে। কোণ ফুলের ঘ্রাণ? বোঝা যাচ্ছেনা। জানলার গ্রীল গলিয়ে বাগানের শেষ প্রান্তের সারি বাঁধা সুপুরী গাছ গুলোকে দেখতে পাচ্ছে তারা। বাতাসে কি সুন্দর দোল খাচ্ছে সুপুরী গাছের পাতাগুলি!
চাঁদের কাছে আজ টিনা চাইলো মজার এক জিনিষ। অনেকদিন ভেবেছিলো সে এ জিনিষটা সে চাঁদের কাছে চাইবে। লজ্জায় কখনো চাইতে পারেনি। আজ তার কাছে আসা বিশেষ অতিথিদের জন্য সে চাঁদের কাছে হাসি মুখে চাইলো সে জিনিসটা- চাঁদণি হালুয়া। চাঁদ ও আজ দারুণ খোশ মেজাজে আছে। একেতো আজ পূর্ণিমা রাত, তার উপর আজ-ই প্রথম পৃথিবীর বুকে তার খুব প্রিয় মানুষ- টিনার সাথে হলো মিতালী। চাঁদ খুশি হয়ে হাসতেই আকাশটা আরও ফর্সা হয়ে উঠলো আলোয়, সেই সাথে গলে গলে পড়তে লাগলো চাঁদণি হালুয়া!
নতুন সুপুরীর গা থেকে আলতো করে ছাড়ানো নরম পাতলা খোসার উত্তল বাটিতে ভরে ভরে নিলো টিনা সেই হালুয়া। পাতাবাহারের কচি পাতা দিয়ে বানালো হালুয়া খাওয়ার চামচ। অত্যন্ত সুস্বাদু সেই চাঁদণি হালুয়া দিয়ে নতুন বউ- পিনি আর বর- পিকিকে আপ্যায়ণ করলো টিনা। অনেক গল্প করে করে রাতের অনেকটা সময় পাড় করে দিলো টিনা ওই নতুন পিঁপড়ে দম্পতির সাথে।

মধ্য রাত্রীতে আকাশটা ঝিমুচ্ছে যখন, চাঁদের চোখও যখন ঢুলু-ঢুলু; পিঁপড়ে কনে বউ- পিনি হাই তুল্লো। বড্ড ক্লান্ত লাগছে তার! টিনা এসে তার ঘরের জানলার কাছে এনে রাখলো চিটাগাং এর কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকত থেকে কিনে আনা ঝিনুকের ছোট্ট ঘরটি। তুলোর গদি পেতে, তার উপর বেলি ফুলের পাপড়ি ছড়িয়ে তাতে পিকি আর পিনিকে শুতে দিলো। চাঁদের আলোতে চক-মক করে উঠলো ঝিনুকের ঘরটির বাইরের দেয়াল, আর তার ভেতরে পিকি আর পিনি আরামে শুয়ে, বিশ্রাম নিয়ে, গল্প করে করে কাটিয়ে দিলো স্মৃতিময় সুন্দর সে রাত।

সঞ্চারিণী