একজনের হাতে রাম দা। অন্য একজন লম্বা বাঁশের ইশারায় কয়লাবোঝাই বিশাল আকারের নৌকাটিকে নদীর মাঝখানে আটকের পর ৫০০ টাকা দাবি করে। মাঝি অনুনয়-বিনয়ের পর ৩০০ টাকা দিয়ে রক্ষা পায়। এ দৃশ্য গতকাল বৃহস্পতিবার সকালের। মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া ও নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ের মাঝামাঝি মেঘনা সেতু থেকে মুক্তারপুর সেতু পর্যন্ত প্রায় পাঁচ কিলোমিটার নৌপথে ৯টি স্থানে মাস্তানরা মালবাহী নৌযান থেকে এভাবেই চাঁদা তুলছিল। কিশোরগঞ্জের আক্রান্ত নৌযান শ্রমিক ইয়াকুব মিয়া কালের কণ্ঠের কাছে এ বর্ণনা দিয়ে জানান, কেবল মাস্তান নয়, দুটি স্থানে পুলিশও চাঁদা নিচ্ছে। ইয়াকুব মিয়া গতকাল ১১ দফায় আড়াই হাজার টাকা চাঁদা দিতে বাধ্য হয়েছেন বলে দাবি করেন।

আগের দিন বুধবার সুনামগঞ্জের মধ্যনগরের আছানপুরে মালবাহী নৌযান থেকে পুলিশের নামে ২০০ টাকা করে চাঁদা তুলছিল স্থানীয় যুবক মহিবুল। চাঁদা তোলার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ইতা মালিকরে জিগাইন। আমরা কিস্তা কইতাম ফারতাম না।’ প্রমিত বাংলায় এর অর্থ দাড়ায়_’এ বিষয়ে মালিককে প্রশ্ন করুন। আমরা কিছু বলতে পারব না।’ কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর উপজেলার কৈলাগ গ্রামের শ্রমিক আসমত আলী চাঁদাবাজির প্রতিবাদ করায় গত ৪ ডিসেম্বর তাহিরপুরে ছুরিকাহত হন। আসমত আলী জানান, শ্রীপুর ইউনিয়নের বৈঠাখালী বাঁধে তিনটি গ্রুপ ওইদিন পৃথকভাবে চাঁদা তুলছিল। তিন জায়গায় চাঁদা নেওয়ার কারণ জিজ্ঞাসা করলে শিবরামপুরের আতাবর তাঁর উরুতে ছুরিকাঘাত করে এবং নগদ ১৭ হাজার ১৫০ টাকা ছিনিয়ে নেয়।

এভাবেই ঢাকা থেকে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সীমান্ত পর্যন্ত প্রায় ৩০০ কিলোমিটার জলপথ চাঁদাবাজ-মাস্তানরা নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। এদের প্রধান টার্গেট জ্বালানি ও নির্মাণসামগ্রী পরিবহনে ব্যবহৃত দেশি লাগসই প্রযুক্তির ইস্পাত নির্মিত নৌযান। কয়লা, পাথর, বালি, সিমেন্টবাহী শত শত নৌযান থেকে এরা নানা অজুহাতে চাঁদা তোলে। টাকা না দিলে মাঝি-মাল্লাদের নির্যাতন করা হয়। একেকটি মালবাহী নৌযানকে সীমান্ত থেকে ঢাকায় পেঁৗছাতে গড়ে ১০ হাজার টাকা চাঁদা দিতে হয়। সে হিসাবে একটি নৌযান বছরে ২৫-৩০টি ট্রিপ দিতে গিয়ে প্রায় তিন লাখ টাকা চাঁদা দেয়। পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে পরিবহন ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেছেন, এ রুটের প্রায় তিন হাজার নৌযান থেকে বছরে আদায় করা হচ্ছে কমপক্ষে ৯০ কোটি টাকা।

নৌযান মালিক ও শ্রমিকরা এক যুগ ধরে নৌপথে অরাজকতা বন্ধের দাবি জানিয়ে আসছেন। নৌপথ অবরোধও করা হয়েছে। তাঁদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তৎকালীন পুলিশের উপ-মহাপরিদর্শকের (অপরাধ) নির্দেশে ২০০৮ সালের ৬ নভেম্বর ঢাকায় অনুষ্ঠিত বৈঠকে নৌপথে অপরাধ দমনে নৌপুলিশ ইউনিট গঠন, নৌথানা স্থাপন, শক্তিশালী নৌযান, জ্বালানির পরিমাণ ও লোকবল বৃদ্ধিসহ ১৫ দফা সুপারিশ করা হয়। দুই বছর পার হয়ে গেলেও এর কোনো সুপারিশ কার্যকর করা হয়নি। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে গত সোমবার উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় নৌযান মালিক ও নৌপরিবহন শ্রমিক সমিতির পক্ষ থেকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে আবেদন জানানো হয়েছে।

প্রসঙ্গত, নৌপথে সহজে চলাচলের উপযোগী করে নির্মিত এসব নৌযানে জ্বালানি ও নির্মাণসামগ্রী পরিবহন খরচ কম। পরিবহন ব্যবসায়ীরা এ খাতে শত শত কোটি টাকা বিনিয়োগ করছেন। সরকারও বিপুল পরিমাণ টাকা কর নিচ্ছে। তাহিরপুর কয়লা আমদানীকারক গ্রুপের তথ্যমতে, সীমান্তের বড়ছড়া, চারাগাঁও ও বাগলি শুল্ক স্টেশন থেকে প্রতিবছর হাজার হাজার মেট্রিক টন কয়লা ও চুনা পাথর আমদানির সূত্রে সরকার বছরে ১০০ কোটি টাকার বেশি রাজস্ব পায়। সুলভে পরিবহনের সুযোগ থাকায় এসব জ্বালানি ও নির্মাণসামগ্রী রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রধানত এসব নৌযানেই পরিবহন করা হয়। বেপরোয়া চাঁদাবাজির ফলে বিকাশমান এ শিল্প হুমকির মুখে পড়েছে।

নৌযান শ্রমিকরা জানান, চাঁদাবাজরা সম্প্রতি চাঁদার অঙ্ক বাড়িয়ে দিয়েছে। তাহিরপুরের ডাম্পেরবাজার ঘাটে খুঁটি গাড়ার নামে (যেখানে নৌযানে মালামাল তোলা হয়) প্রতি নৌযান থেকে ২০০ টাকা, শ্রীপুর ঘাটে ৪০০ টাকা, সুলেমানপুরে ২০০ টাকা, ঘাগড়া ও ফাজিলপুর বালু ও পাথর কোয়ারি থেকে ফেরার পথে তিন দফায় ৭০০ টাকা, আছানপুর নদীতে মধ্যনগর থানার পুলিশের নামে ২০০ টাকা, দুর্লভপুর ৫০০ থেকে ৮০০ টাকা, ধরমপাশার শানবাড়ি বাজারের পাশে সংসদ সদস্যের ভাইয়ের মাছ ধরার খেওয়ের ক্ষতির অজুহাতে পাঁচ থেকে ২০ হাজার টাকা, মাহমুদপুর ও মুক্তারপুরের মাঝমাঝি স্থানে ৪০০ টাকা, লালপুরে মার্কার (নদী চিহ্নিত করা) নামে ১০০ টাকা, ধরমপাশা পুলিশের নামে ২০০ টাকা, ছাতকে তিন স্থানে মোট সাড়ে ৮০০ টাকা, কিশোরগঞ্জের মিঠামইন, নিকলী, বাজিতপুর ও ভৈরবে পুলিশের নামে ১০০ টাকা করে, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সলিমগঞ্জে পুলিশ ফাঁড়ির নামে ৩০০ টাকা, নরসিংদীর শ্রীনগরে পুলিশের নামে ৩০০ টাকা, কুমিল্লার মেঘনা থানা পুলিশের নামে ৩০০ টাকা, নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার থানার খাককান্দায় পুলিশের নামে ৫০০ টাকা, সোনারগাঁওয়ের বৈদ্যেরবাজারে পুলিশের নামে ৩০০ টাকা করে আদায় করা হচ্ছে।
সুনামগঞ্জের ছাতক, কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সরাইলের মধ্যবর্তী মেঘনার মোহনা, মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া, সোনারগাঁওয়ের মেঘনা সেতুর ভাটি, কেরানীগঞ্জের কামরাঙ্গীরচরসহ ১০-১২ স্থানে নিয়মিত ডাকাতি হচ্ছে। এতে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন দরিদ্র নৌশ্রমিকরা। ডাকাতদের হাতে নিরীহ নৌযান শ্রমিকরা অহরহ খুনও হচ্ছেন। শ্রমিকরা জানান, গত ১২ বছরে শতাধিক নৌযান শ্রমিক ডাকাত ও ছিনতাইকারীদের হাতে প্রাণ দিয়েছেন। ২০০৮ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ে বাজিতপুরের কুকরারাইয়ের চার শ্রমিক জলদস্যুদের হাতে নিহত হন।

উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় নৌযান মালিক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক তফাজ্জল হোসেন বাদল বলেন, ‘৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে নৌপথে চাঁদাবাজি বন্ধ না হলে আমাদের সমিতিভুক্ত নৌযান থেকে সরকার নির্ধারিত কর দেওয়া বন্ধ করে দিতে বাধ্য হবে।’ নৌপরিবহন শ্রমিক সমিতির সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ২৫-৩০ হাজার শ্রমিক এ পেশায় থেকে সংসার চালান। তাঁদের যৎসামান্য আয়ের বেশির ভাগই চাঁদাবাজ ও পুলিশের পকেটে চলে যায়। চাঁদাবাজি বন্ধে ব্যবস্থা না নিলে আন্দোলনে যাওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না। সরাইল স্টিলবডি নৌযান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক হাজি মো. রেহানউদ্দিন বলেন, ‘একেকটি মালবাহী নৌযানকে বছরে কমপক্ষে তিন লাখ টাকা অবৈধ চাঁদা দিতে হয়। প্রায় তিন হাজার নৌযান বছরের পর বছর ধরে এভাবে চাঁদা দিয়ে আসছে। এভাবে চললে কেবল গরিব মাঝিমাল্লা নয়, আমরাও পথে বসব।’

কয়লা আমদানীকারক গ্রুপের (তাহিরপুর) সাধারণ সম্পাদক মো. মকবুল হোসেন বলেন, ‘চাঁদাবাজি বন্ধ করতে আমরা প্রশাসনকে তাগিদ করছি।’ তিনি জানান, এ খাত থেকে সরকার প্রতিবছর প্রায় ১০০ কোটি টাকার বেশি রাজস্ব পাচ্ছে। চাঁদাবাজির কারণে কয়লার ক্রেতা কমে যাচ্ছে, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে নৌযান শ্রমিকরা। এভাবে চলতে থাকলে রাজস্ব আয় নিশ্চিত কমে যাবে। ঢাকার গাবতলীর কয়লা ব্যবসায়ী মো. সুরুদ্দিন বলেন, চাঁদাবাজির কারণে নৌযান শ্রমিকরা ধর্মঘটে গেলে কয়লার অভাবে ঢাকাসহ দেশের ২৫ ভাগ ইটভাটার আগুন নিভে যাবে।

চাঁদা আদায় প্রসঙ্গে বাজিতপুর থানার ওসি মো. আকতারুজ্জামানের সরকারি মোবাইল ফোনে কথা বলার চেষ্টা করা হলেও অপর প্রান্ত থেকে লাইন কেটে দেওয়া হয়। তাহিরপুর থানার ওসি মামুনুর রশিদ জানান, খাস কালেকশন ও দেবোত্তর সম্পত্তির নামে দুটি গ্রুপ চাঁদাবাজি করছিল। শনিবার চাঁদাবাজি ও এক নৌশ্রমিককে প্রহারের ঘটনায় মামলা দায়েরের পর থেকে চাঁদাবাজরা পলাতক রয়েছে। পুলিশের নামে চাঁদা আদায়ের অভিযোগ সম্পর্কে তাঁর ভাষ্য, ‘অভিযোগ ঠিক নয়।’

কিশোরগঞ্জ-৫ আসনের আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য মো. আফজাল হোসেন ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট জিয়াউল হক মৃধা সোমবার (৬ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুনের সঙ্গে দেখা করে নৌপথে অরাজকতার চিত্র তুলে ধরে নৌযান শ্রমিক ও মালিকদের আবেদন তাঁর কাছে হস্তান্তর করেন। সংসদ সদস্য আফজাল হোসেন জানান, নৌপথে চাঁদাবাজি বন্ধের বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। তিনি (স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী) সন্ত্রাস-চাঁদাবাজি বন্ধের আশ্বাস দিয়েছেন।

লিখেছেনঃ নাসরুল আনোয়ার, নিজস্ব প্রতিবেদক, কালের কণ্ঠ