ভারতের অভ্যন্তরে অবস্থিত লালমনিরহাট জেলার অন্তর্গত বাংলাদেশী ৩৫টি ছিটমহলের মধ্যে আঙ্গরপোতা-দহগ্রাম ছিটমহল দুটির ১৬ হাজার বাঙালির অবরুদ্ধ জীবনযাপনের করুণ কাহিনীর আংশিক অবসান হলেও বাকি ৩৩টি ছিটমহলে বসবাসরত দেড় লক্ষাধিক বাঙালির অবরুদ্ধ জীবনযাপনের করুণ কাহিনী এখনো অশ্র“ মঙ্গলের পালা গেয়ে যাচ্ছে।
ভারতের তিনবিঘা কড়িডোর দিয়ে আঙ্গরপোতা-দহগ্রাম ছিটমহল দুটির বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ড লালমনিরহাট জেলার পাটগ্রাম উপজেলার সাথে সরাসরি সংযোগ স্থাপন তৎকালীন বিএনপি সরকারের আমলে ১৯৯২ সালের ২৬ জুন। কিন্তু দিনের ১২ ঘণ্টার জন্য প্রতি একঘণ্টা পর পর ভারতের তিনবিঘা কড়িডোরে লোহার দরজা খোলা হতো। কিন্তু ১৯৯৬ সালে উভয় দেশের উচ্চ পর্যায়ে বৈঠক করে শুধুর দিনের বেলা সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ১২ ঘণ্টার জন্য লৌহ দরজা সবসময় খোলা থাকে। কিন্তু রাতের ১২ ঘণ্টায় তারা সম্পূর্ণভাবে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন।

কিন্তু বাকি ৩৩টি ছিটমহলে বসবাসরত বাংলাদেশীদের অবরুদ্ধ জীবনযাপন এখনো করুণ কাহিনীর সুতোয় গাঁথা। তারা বাংলাদেশী ভূখণ্ডে বসবাস করে তাই তারা বাংলাদেশী। কিন্তু বাংলাদেশের সাথে তাদের কোন যোগাযোগ নেই। তারা রাষ্ট্রীয় সকল প্রকার সুবিধা বঞ্চিত। এসব ছিটমহলে বসবাসরত বাংলাদেশীদের জীবনযাপন বন্যপ্রাণীর চেয়ে নিষ্ঠুর ও করুণ।

আঙ্গরপোতা ও দহগ্রাম ছিটমহল দুটি বাদে লালমনিরহাট জেলার বাকি ৩৩টি ছিটমহল হলো পাটগ্রাম উপজেলার অধীনে শ্রীরামপুর (আয়তন ১.০৮ একর ভূমি), জোত নিজাম (আয়তন ৮৭.৫৪ একর ভূমি), জগতবেড় (আয়তন ৬৯.৮৪ একর ভূমি), জগতবেড়-১ (আয়তন ৩০.৬৬ একর ভূমি), জগতবেড়-২ (আয়তন ২৭.০৯ একর ভূমি), বামনদল (আয়তন ২.৩০ একর ভূমি), ধবলসুতি (আয়তন ৬৬.৫৮ একর ভূমি), ধবলসুতি মির্জাপুর (আয়তন ১৭৩.৮৮ একর ভূমি), ধবলসুতি মির্জাপুর-১ (আয়তন ৬০.৪৫ একর ভূমি), চিটান বাড়ি (আয়তন ১০৮.৫৯ একর ভূমি), কুচলিবাড়ি (আয়তন ১.৮৩ একর ভূমি), বালা পুকুরি (আয়তন ৩৩১.৬৪ একর ভূমি), কুচলিবাড়ি-২ (আয়তন ৩৭০.৬৪ একর ভূমি), কাকেয়া বাড়ি (২৯.৪৯ একর ভূমি), ভান্দরদহ (আয়তন ৩৯.৯৬ একর ভূমি), ধবলগুড়ি (আয়তন ১২.৫০ একর ভূমি), ধবলগুড়ি-৫ (আয়তন ৪.১২ একর ভূমি), ধবলগুড়ি-৪ (আয়তন ৪.৫৫ একর ভূমি), ধবলগুড়ি-১ (আয়তন ২২.৩১ একর ভূমি), সিটল্যান্ড-৩ (আয়তন ১.৩৩ একর ভূমি), সিটল্যান্ড ৩/১ (আয়তন ২৬.৮৩ একর ভূমি), সিটল্যান্ড-২ (আয়তন ১৩.৯৫ একর ভূমি), মহিষামুড়ি (আয়তন ১২২.৭৭ একর ভূমি), ফলানপুর (আয়তন ৫০৬.৮৩ একর ভুমি), নলগ্রাম (আয়তন ১৩৯৭.৩৪ একর ভূমি) ও সিট নলগ্রাম (আয়তন ৭৭.৩৭ একর ভূমি), হাতীবান্ধা উপজেলার অধীনে বুড়া সড়োডুবি (আয়তন ৩৪.৯৬ একর ভূমি) ও আমঝোল (আয়তন ১.২৫ একর ভূমি), আদিতমারী উপজেলার অধীনে কিসামত বত্রিগাছ (আয়তন ২০৯.৯৫ একর ভূমি), বত্রিগাছ (আয়তন ৫৭৭.৩৭ একর ভূমি) ও দুর্গাপুর সিট (আয়তন ২০.৯৬ একর ভূমি) এবং লালমনিরহাট সদর উপজেলার অধীনে হলো বনসুয়া খামার (আয়তন ২০.৯৬ একর ভূমি)। এসব ছিটমহলের সবগুলোই ভারতের পশ্চিমবঙ্গ কুচবিহার ও জলপাইগুঁড়ি জেলায় অন্তর্ভুক্ত।

১৯৮৩ সালে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের অনুমতিসাপেক্ষে ছিটমহলে ভোটার রেজিস্ট্রেশন প্রথমবারের মতো করা হয়। কিন্তু ৩৫টি ছিটমহলের মধ্যে মাত্র ৯টিতে ৫ হাজার ভোটার রেজিস্ট্রেশন করা হয়। পরে বাকি ছিটমহলগুলোতে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা সৃষ্টি হয় ভারতীয় কর্তৃপক্ষের। তবে ১৯৯০ সালে ৩৫টির মধ্যে ২০টি ছিটমহলে ভোটার রেজিস্ট্রেশন করা হয় ভারতীয় কর্তৃপক্ষের অনুমতি ও নির্দেশিকা অনুযায়ী। সে সময় ২০টি ছিটমহলের ২৫ হাজার মানুষকে ভোটার করা হয়। ১৯৯৫ ও ১৯৯৯ সালে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কোন অনুমতি না মিললে এসব ছিটমহলে ভোটার রেজিস্ট্রেশন করা সম্ভব হয়নি। তবে ২০০০ সালে নির্দেশিকা সাপেক্ষে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের অনুমতি মিললে মাত্র দুটি ছিটমহলে কিছু ভোটার রেজিস্ট্রেশন করার পরই উঠে যায় ভারতীয় কর্তৃপক্ষের অনুমতি। কিন্তু ছিটমহলের ভোটাররা ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বিএসএফের বাধার কারণে তারা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডে এসে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেননি।

২০০৮ সালে সারা দেশব্যাপী ছবিযুক্ত ভোটার তালিকা প্রস্তুত করা হলেও বাদ পড়ে গেছে ভারতের অভ্যন্তরে বাংলাদেশের ৩৩ ছিটমহলের বাসিন্দারা। শুধু আঙ্গরপোতা-দহগ্রাম ছিটমহল দুটির বাসিন্দাদের ছবিযুক্ত ভোটার করার অনুমতি দেয় ভারতীয় কর্তৃপক্ষ কিন্তু বাকি ৩৩টি ছিটমহলে প্রবেশের কোন অনুমতি না থাকায় নির্বাচন কমিশন এখানকার অধিবাসীদের ছবিযুক্ত ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তি করতে ব্যর্থ হয়। এসব ছিটমহলে বসবাসরত বাংলাদেশীরা স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, কর্ম, শিক্ষা, আইনের শাসনসহ সকল প্রকার সুবিধা থেকে বঞ্চিত। তারা আসতে পারে না বাংলাদেশী মুল ভূখণ্ডে আর পায় না ভারতীয় সরকারের কোন সুবিধা। শুধু ভারতের মাটিতে কাজকর্ম করে এবং হাটবাজার থেকে জীবন জীবিকা নির্বাহ করে। ছিটমহলে বসবাসরত বাংলাদেশী নাগরিকদের অধিকাংশ বিশেষ করে মহিলার ভারতের মুদ্রা চেনেন না। কিন্তু তারা বাংলাদেশের নাগরিক। ছিটমহলগুলোতে নেই কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। তাই এখানকার ৯০ শতাংশ মানুষ অক্ষর জ্ঞানহীন বাকি ১০ শতাংশ মানুষ বিশেষ করে মহিলার আরবি শিক্ষায় শিক্ষিত। নিজেদের উদ্যোগে ছোট ছোট মক্তব তৈরি করে আরবি শিক্ষার কিছুটা প্রচলন আছে এসব ছিটমহলে। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স কিংবা হাসপতাল নেই ছিটমহলগুলোতে। এ কারণে অধিকাংশ মানুষ স্বাস্থ্যহীন হয়ে বিভিন্ন দুরারোগ্য ব্যাধিতে ধুঁকে ধুঁকে মারা যায়। নেই কোন কলকারখানা, দোকানপাট, অফিস আদালত। কর্ম করার সুযোগ নেই তাদের।

ভারতীয় নাগরিকদের সাথে সখ্য গড়ে তুলে ভারতে দিনমজুর শ্রমজীবীর কাজ করতে হয়। ভারতীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছিটমহলের শিশুদের পড়াশোনা করতে দেয়া হয় না। ভারতের হাসপাতালে ভর্তি করা হয় না ছিটমহলে বসবাসরত বাংলাদেশী কোন রোগীকে। ভারত সরকারের ত্রাণ নিতে গেলে অর্ধচন্দ্র খেয়ে ফিরে আসতে হয় ছিটমহলবাসীকে। এখানকার অধিবাসীরা আত্মীয়তা করতে জটিল সমস্যায় পড়ে যান। এখানকার ছেলেমেয়েদের সাথে ভারতের কোন নাগরিকের বিয়ে কিংবা সম্পর্ক স্থাপন করতে দেয়া হয় না। এমনকি বাংলাদেশের মূল-ভূখণ্ডে বসবাসরত বাংলাদেশীদের কেউই তাদের মেয়ের বিয়ে ছিটমহলের ছেলের সাথে দিতে চায় না। তবে ছিটমহলের মেয়ের সাথে বিয়ে দিয়ে বধূ করে আনছেন অনেকে। তারা বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডে আসতে চায় কিন্তু বিএসএফ তাদের অনুমতি দেয় না। বিএসএফের বাধার মুখে কোণঠাসা এখানকার অধিবাসীরা। তবে বিএসএফের চোখ ফাঁকি দিয়ে অনেকেই বাংলাদেশে এসে কাজকর্ম করে অর্থ উপার্জন করেন। আন্তর্জাতিক আইনি জটিলতা থাকায় ছিটমহল ভূখণ্ডে ভারত ও বাংলাদেশ উভয় দেশের প্রশাসন প্রবেশ করতে পারবে না। ভারতের দুষ্কৃতকারীরা এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ছিটমহলবাসীকে অস্ত্রের ভয়ে জিম্মি করে ছিটমহলে তৈরি করে তাদের অবৈধ আস্তানা। মদপান, জুয়ার আসরসহ বিভিন্ন প্রকার অসামাজিক কার্যকলাপ তারা চালিয়ে যান নির্দ্বিধায়। ছিটমহলবাসীরা শুধু নির্বাক নয়নে সহ্য করে যায় তাদের অত্যাচার।

ছিটমহলবাসীরা মুক্তি চায় তাদের অবরুদ্ধ জীবনের। স্বাধীনতার পর থেকেই অবরুদ্ধ জীবনযাপন করে তারা ক্লান্ত। তাদের দাবি হয় তাদের ভারতীয় নাগরিক করা হোক অথবা বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডে অবাধ যাতায়াতের সুযোগ দেয়া হোক। দুটির একটিও করা না হলে তাদের গুলি করে হত্যা করে ছিটমহলগুলোকে জনশূন্য করা হোক। এ রকম দাবি ছিটমহলবাসীর। বৃহস্পতিবার সকালে লালমনিরহাট জেলার আদিতমারী উপজেলার দুর্গাপুর বাজারে বাত্রিগাছ ছিটমহল থেকে আসা রহিম বকস (৪০), খালেক (৩৬), মনির (৩০), সালাম (৪২), রহিম (২৫), ভুট্টু (২৮) ও খোকাসহ (৩৩) বেশ কয়েকজন ছিটমহলবাসী আসেন। তাদের সাথে কথা হলে তারা এ রকমটি জানান। তারা আরো জানান, বাংলাদেশী ভূখণ্ডে বাস করেও তারা ভোটাধিকার থেকে শুরু করে সকল প্রকার অধিকার বঞ্চিত। স্বাধীনতার পর তারা ৩ বার ভোটার হলেও ভোট দিতে পারেননি। খোকা জানান, আমরা বাত্রিগাছ ছিটমহলের মানুষ অনেক সময়ই নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে সীমান্তে বিএসএফের চোখ ফাঁকি দিয়ে গোপনে বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডে আসি।

ছিটমহলবাসীদের চোখে এখন স্বপ্ন বর্তমান সরকার ভারত সরকারের উচ্চ পর্যায়ে বৈঠক করে আলোচনা সাপেক্ষে তাদেরকে অবরুদ্ধ জীবনযাপন থেকে মুক্ত করে স্বাধীনতার অপূরণীয় স্বাদ আস্বাদনের সুযোগ করে দেবে। তারা আরো জানান, সময় এসেছে দুই দেশের উচ্চ পর্যায়ে ছিটমহল সমস্যা নিয়ে কথা বলার ও সমাধানের পথ তৈরি করার। এ সময়ে সম্ভব না হলে আগামী শত যুগ পাড়ি দিলেও ছিটমহল সমস্যা সমস্যাই থেকে যাবে বলে তারা আশংকা করেন।