জাতীয় শিক্ষানীতির খসড়া থেকে শেষ পর্যন্ত ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ শব্দটি বাদ দেওয়া হয়েছে। এর বদলে যুক্ত করা হয়েছে ‘অসাম্প্রদায়িক চেতনাবোধ’। গতকাল সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রায় এক বছর ধরে আলোচিত জাতীয় শিক্ষানীতি অনুমোদিত হয়েছে।
খসড়া শিক্ষানীতির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের মধ্যে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ শব্দটি উল্লেখ করায় বিভিন্ন ধর্মভিত্তিক দল ও চারদলীয় জোটের অনুসারীরা এ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। এটিসহ কিছু বিষয়কে কেন্দ্র করে আন্দোলনও শুরু হয়। তাদের বক্তব্য ছিল, দেশের বতর্মান সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার উল্লেখ নেই।
শিক্ষাবিদ এমাজউদ্দীন আহমদ তাঁর ছাত্র ও বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদকে চিঠি দিয়ে বলেছিলেন, সংবিধান পরিবর্তন না করা পর্যন্ত ধর্মনিরপেক্ষ শব্দটি ব্যবহার করা উচিত নয়। তাঁর মত ছিল, এত বড় একটি উদ্যোগ বাস্তবায়নের আগে শব্দচয়নে সতর্ক থাকা উচিত।
জানা যায়, শব্দটি নিয়ে বিভিন্ন মহলের আপত্তির পরিপ্রেক্ষিতে এটা বাদ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া শিক্ষানীতির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য প্রসঙ্গে ‘মুক্তবুদ্ধির চর্চা’ কথাটি নতুনভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। আরও উল্লেখ করা হয়েছে, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার্থীদের নিজ নিজ ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষার মাধ্যমে উন্নত চরিত্র গঠনে সহায়তা করা হবে এই নীতির লক্ষ্য।
শিক্ষামন্ত্রী গতকাল এক প্রতিক্রিয়ায় প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার ১৪ বছরের স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। আমি যখন আওয়ামী লীগের শিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক ছিলাম, তখন এ ব্যাপারে আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। আজ আমার সেই স্বপ্ন পূরণ হলো।’ তিনি বলেন, মন্ত্রিসভা শিক্ষানীতিটি সানন্দে গ্রহণ করেছে। শিক্ষানীতি চূড়ান্ত করার আগে ৪৯টি সেমিনার করা হয়েছে।
জানা যায়, মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিক্ষানীতি চূড়ান্ত হওয়ায় শিক্ষামন্ত্রী, শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটি এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। তিনি বলেন, প্রয়োজনে এই শিক্ষানীতি সংশোধন ও সংযোজনের সুযোগ থাকছে।
মন্ত্রিসভার বৈঠক শেষে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ শিক্ষানীতির বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন।
জানা যায়, মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের পর এখন জাতীয় শিক্ষানীতি সংসদে উত্থাপিত হবে। শিক্ষানীতি বাস্তবায়নে আগামী ২০১৭-১৮ সাল পর্যন্ত খরচ হবে প্রায় ৬৮ হাজার কোটি টাকা।
গত বছরের ৮ এপ্রিল জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরীকে প্রধান করে জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটি গঠন করা হয়। প্রস্তাবিত শিক্ষানীতিতে প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণী এবং মাধ্যমিক শিক্ষাকে নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত করা হয়েছে। প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা চালু ও মাদ্রাসাশিক্ষাকে আধুনিকায়নের বিধান রাখা হয়েছে। এই নীতিতে পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণীতে সমাপনী পরীক্ষার বিধান রাখা হয়েছে।
নতুন ছয়টি বিষয়: শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বিষয়ে চূড়ান্ত খসড়ায় ২৪টি বিষয় উল্লেখ ছিল। গতকাল মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত শিক্ষানীতিতে ৩০টি বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। নতুনভাবে অন্তর্ভুক্ত হওয়া বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে শিক্ষায় পিছিয়ে পড়া এলাকাগুলোর জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া, বাংলা ভাষা শুদ্ধ ও ভালোভাবে শিক্ষা দেওয়া নিশ্চিত করা, সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মাঠ, খেলাধুলা ও শরীরচর্চার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা, শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যসচেতন করতে বিভিন্ন ব্যবস্থা এবং মাদকজাতীয় দ্রব্যের বিপদ সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের সতর্ক ও সচেতন করা।
ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা: খসড়া শিক্ষানীতিতে নৈতিক শিক্ষার প্রসঙ্গ উল্লেখ ছিল না। কিন্তু চূড়ান্ত শিক্ষানীতিতে নৈতিক শিক্ষা সম্পর্কে একটি অনুচ্ছেদ রাখা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ‘নৈতিকতার মৌলিক উৎস ধর্ম। তবে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যসমূহ এবং দেশজ আবহও গুরুত্বপূর্ণ উৎস। নৈতিকতার শিক্ষার ক্ষেত্রে এসব বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করে নৈতিক শিক্ষাদান পদ্ধতি নির্ধারণ করতে হবে।’
যুক্ত হলো কওমি মাদ্রাসা প্রসঙ্গ: চূড়ান্ত খসড়া শিক্ষানীতিতে কওমি মাদ্রাসা প্রসঙ্গ উল্লেখ ছিল না। সাধারণ মাদ্রাসার প্রায় সমানসংখ্যক শিক্ষার্থী কওমি স্তরে পড়াশোনা করে। এই বিরাট স্তর সম্পর্কে শিক্ষানীতিতে কিছু উল্লেখ না থাকায় বিষয়টি নিয়ে সমালোচনা চলছিল। শিক্ষানীতিতে মাদ্রাসাশিক্ষার মধ্যে কওমি মাদ্রাসা প্রসঙ্গ উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, কওমি মাদ্রাসার ক্ষেত্রে এই শিক্ষা ও ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের নিয়ে একটি কওমি মাদ্রাসাশিক্ষা কমিশন করা হবে। কমিশন কওমি প্রক্রিয়ায় ইসলাম শিক্ষার ব্যবস্থাপনা ও শিক্ষাদান বিষয়ে সুপারিশ তৈরি করে তা সরকারের বিবেচনার জন্য উপস্থাপন করবে।
মাদ্রাসাশিক্ষার সংস্কার: খসড়া শিক্ষানীতিতে বলা হয়েছিল, মাদ্রাসাশিক্ষা বোর্ড শুধু ধর্মীয় শিক্ষার মূল্যায়ন করবে। ধর্মীয় শিক্ষা ছাড়া বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান, সামাজিক বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় মূল্যায়ন করবে সাধারণ শিক্ষা বোর্ড বা প্রস্তাবিত শিক্ষা কাউন্সিল। জাতীয় শিক্ষানীতির চূড়ান্ত খসড়ায় এ কথা উল্লেখ করায় প্রশ্ন ওঠে, মাদ্রাসাশিক্ষা দুই ধরনের বোর্ডের আওতায় চলবে কীভাবে। এর বিরুদ্ধে ধর্মভিত্তিক দলগুলো আন্দোলন করে।
অনুমোদিত শিক্ষানীতিতে মাদ্রাসাশিক্ষার মূল্যায়ন অন্য বোর্ড করার প্রস্তাবটি বাদ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ফাজিল (সম্মান) কোর্স চার বছর এবং কামিল কোর্স এক বছর নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। ইবতেদায়ি আট এবং দাখিল চার বছর করা হয়েছে।
‘ও’ এবং ‘এ’ লেভেলে বাংলা পড়াতে হবে: মাধ্যমিক স্তরের তিন ধারা অর্থাৎ সাধারণ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষা ধারায় বাংলা, ইংরেজি, গণিত, তথ্যপ্রযুক্তি ও বাংলাদেশ স্টাডিজসহ ছয়টি মৌলিক বিষয়ে অভিন্ন পাঠ্যসূচি বাধ্যতামূলক করার সুপারিশ করছে শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটি। কিন্তু খসড়া শিক্ষানীতিতে ‘ও’ এবং ‘এ’ লেভেলের বেলায় এটা ছাড় দেওয়া হয়। গতকাল অনুমোদিত নীতিতে বলা হয়, ‘ও’ এবং ‘এ’ লেভেলে বাংলা এবং বাংলাদেশ স্টাডিজ পাঠ্যসূচিতে যুক্ত করতে হবে। এ দুটি বিষয় পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা সাপেক্ষে ‘ও’ লেভেলকে এসএসসি এবং ‘এ’ লেভেলকে এইচএসসির সমমান বিবেচনা করতে হবে।
প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক শিক্ষা: শিক্ষানীতিতে বলা হয়েছে, পাঁচ বছরের বেশি বয়সী শিশুদের জন্য এক বছর মেয়াদি প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা চালু করাসহ প্রয়োজনীয় পদ সৃষ্টি করা হবে। আদিবাসী শিশুরা যাতে তাদের নিজেদের ভাষা শিখতে পারে, সে লক্ষ্যে আদিবাসী শিক্ষক ও পাঠ্যপুস্তকের ব্যবস্থা করা হবে। প্রাথমিক শিক্ষা হবে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত এবং তা অবৈতনিক, সর্বজনীন ও বাধ্যতামূলক। পঞ্চম শ্রেণীর ফলাফলের ওপর বৃত্তির ব্যবস্থা থাকবে। সব শিক্ষার্থীর জন্য নিজ নিজ ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষার ব্যবস্থা থাকবে।
মাধ্যমিক শিক্ষা: মাধ্যমিক শিক্ষার স্তর হবে নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত। মাধ্যমিক শিক্ষাস্তরে সাধারণ, মাদ্রাসা ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা ধারায় বাংলা, ইংরেজি, গণিত, তথ্যপ্রযুক্তি ও বাংলাদেশ স্টাডিজ শিক্ষায় অভিন্ন শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি অনুসরণ করা হবে। দশম শ্রেণী শেষে সমাপনী পরীক্ষা উপজেলা/পৌরসভা/থানা পর্যায়ে অভিন্ন প্রশ্নপত্রের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত হবে। এই পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে বৃত্তি দেওয়া হবে।
উচ্চশিক্ষা: তিন বছর মেয়াদি ডিগ্রি কোর্সকে পর্যায়ক্রমে সংশ্লিষ্ট সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চার বছর মেয়াদি সম্মান কোর্স রূপান্তর করা হবে। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নির্বাচন এবং তাঁদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য বেসরকারি শিক্ষক কমিশন গঠন করা হবে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় বিকেন্দ্রীকরণের লক্ষ্যে বিভাগীয় সদরে এর কেন্দ্র স্থাপন করা হবে। পরে এই কেন্দ্রগুলোকে নিজ নিজ এলাকায় অনুমোদনকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করা হবে।
বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষা: অষ্টম শ্রেণী শেষে প্রাথমিক সার্টিফিকেট পরীক্ষায় উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীরা ইচ্ছা করলে বৃত্তিমূলক শিক্ষায় প্রবেশ করতে পারবে। বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে প্রতিটি উপজেলায় একটি কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা হবে। এ ছাড়া পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, টেক্সটাইল ইনস্টিটিউট ও লেদার ইনস্টিটিউটের সংখ্যা বাড়ানো হবে।