অশোক শব্দটির অর্থ বীতশোক অর্থাত্ শোকহীন। মানবজন্মের দুঃখ-শোক অবসানের জন্য যিনি কঠিন তপস্যায় বোধিসত্ত্ব লাভ করেছিলেন, সেই গৌতম ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন এই অশোকতরুতলে। অনেকেই ভাবতে পারেন, ঘটনাটি কাকতালীয়। কিন্তু সে যা-ই হোক, এ ঘটনার পর অশোকতরুর জগত্খ্যাত হতে আর কি কিছু লাগে? উপরন্তু কথিত আছে, এই তরুতলেই তপস্যা করে গৌরী তাঁর শোকতাপ মুক্ত হয়ে সিদ্ধি লাভ করেছিলেন। সেই থেকে নাকি এর নাম হয়েছে অশোক (অমরকোষ)। ভগবান বিষ্ণুরও এক নাম অশোক। আর মগধের রাজা অশোকের কীর্তি তো অক্ষয় হয়েই আছে ইতিহাসের পাতায়। অশোক নিয়ে পুরাণ কাব্যে উচ্ছ্বাসের অন্ত নেই। সংস্কৃত কবিরা ভাবতেন, অশোক ফোটে লাস্যময়ী তরুণীদের পদস্পর্শে।
দেবেন্দ্রনাথ সেন অশোক গুচ্ছ নামে কাব্যই রচনা করেছেন। এতে আছে, ‘হে অশোক, কোন রাঙ্গা চরণচুম্বনে মর্ম্মে মর্ম্মে শিহরিয়া হলি লালে লাল।’ আর রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘আসতো তারা কুঞ্জবনে চৈত্র জ্যোত্স্নারাতে/ অশোক শাখা উঠত ফুটে প্রিয়ার পদাঘাতে।’ প্রিয়ার পদস্পর্শ পাক আর না-ই পাক, বসন্তের স্পর্শে এখন রক্তিম হয়ে আছে অশোকের শাখা।
অশোক একসময় প্রচুর ছিল দেশে। এখন তার দেখা পাওয়া যায় না খুব একটা। ঢাকায় বেশ কিছু অশোক আছে রমনা উদ্যানে, জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানেও। উদ্ভিদবিজ্ঞানী দ্বিজেন শর্মা তাঁর শ্যামলী নিসর্গ বইতে অশোকের বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন। এর বৈজ্ঞানিক নাম সারাকা ইন্ডিকা লিন (Saraca Indica Lin)। মাঝারি আকারের ঝাঁকড়া চিরসবুজ গাছ। কাণ্ড ধূসর, মসৃণ। পাতা লম্বা ধরনের। হালকা তামাটে রঙের অশোকের কচিপাতাও খুব সুন্দর দেখায়। ঘন পাতার সন্নিবেশে থোকায় থোকায় ফুল ফোটে। নতুন ফুল কমলা রঙের, দিনে দিনে রক্তিম হয়ে ওঠে। অনেক সময় কাণ্ডের বাকল ফেটেও থোকা থোকা ফুল ফুটতে দেখা যায়। বাসন্তী হাওয়ায় ছড়িয়ে পড়ে তার মধুর সৌরভ। দ্বিজেন শর্মা তাঁর বইতে জানিয়েছেন, বসন্ত ও হেমন্তেই অশোকের প্রধান প্রস্ফুটনকাল। তবে সারা বছরই অল্পবিস্তর ফুল ফোটে। ফল শিমের মতো।বীজ থেকে সহজেই চারা গজায়, বাড়ে খুবই ধীরে।
অশোক শুধু দর্শনদারিই নয়, ঔষধিগুণেও অনন্য। দেশের প্রাচীন ইউনানি চিকিত্সা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তিব্বিয়া হাবিবিয়া কলেজের সহকারী অধ্যাপক হাকিম ফেরদৌস ওয়াহিদ জানিয়েছেন, ফুল ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়ায়। এ ছাড়া আন্ত্রিক রোগ, উদরাময়, গর্ভধারণের সমস্যা ও স্ত্রীরোগের চিকিত্সায় এর উচ্চমানের কার্যকারিতা রয়েছে। বিখ্যাত আয়ুর্বেদিক ওষুধ অশোকারিস্ট।
বসন্ত যেমন প্রেমের ঋতু, তেমনি অশোকও প্রেমের ফুল। প্রেমের দেবতা কন্দর্পের পঞ্চশরের অন্যতম রক্তিম অশোক (অরবিন্দ, অশোক, চূত, নবমল্লিকা, নীলোত্পল)। আবার অশোক আছে পঞ্চবটীতেও (অশ্বত্থ, অশোক, বট, বিল্ব, আমলকী)।