ট্রিপ- চাঁদপুরহাঁটছি চাঁদপুরের রেললাইন ধরে। চাঁদপুর কোর্ট স্টেশন থেকে যাবো বড় স্টেশনে। তারপর ইলিশ মাছের আড়তে।ঘড়ির কাটা তখন রাত নয়টা ছাড়িয়ে। রেল লাইনের দু’পাশেই বসতি এবং দোকানঘর। ঘরগুলোর ঝকমকে আলোয় মাঝে মাঝেই উজ্জ্বল হয়ে উঠছি আমরা। একবার আলোকিত হচ্ছি, আবার ডুবে যাচ্ছি ঘুটঘুটে অন্ধকারে। একেবারে সামনের সারিতে অনেকটা এগিয়ে গেছে তুহিন ও রোমন।
এর আরো একটু পেছনে সজিবের সাথে হাঁটছেন আহমদ আমিন । আর এ দু’জনের সাথে তাল রাখার চেষ্টা করছে সাদ। কিন্তু হঠাৎ করেই হাঁটার তাল হারিয়ে ফেললো সে। আমি তখন ওদের থেকে অনেক পেছনে। উদাসি হয়ে লাইনের স্লিপার গুনতে গুনতে এগুচ্ছি। সাদকে দেখলাম থেমে যেতে। তারপর দুই স্লিপার পেছনে এসে একেবারে আমার মুখোমুখি। ঘটনা কী?ঘটনা তেমন কিছুই নয়। ওর ফোনে আমার কল এসেছে।কানে নিতেই ওপাশ থেকে সাবরিনার কণ্ঠ- হ্যালো…আমি গড়গড় করে একটু আগে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর বিবরণ দিতে শুরু করলাম।
কিন্তু থামিয়ে দিলেন সাবরিনা- আগেই সব শুনবো না। তাহলে ভ্রমণবিত্তান্ত পড়ে মজা পাওয়া যাবে না।সাবরিনা সোবহান নিশিদলের সদস্য না হয়েও দলের ওপর খবরদারি করেন। দলের ভালো-মন্দ বিশ্লেষণ করেন। সূঁচারু দৃষ্টি রাখেন আমাদের গতিবিধির ওপর। আর রাতভ্রমণের লেখাগুলো নিয়ে উপস্থাপন করেন যৌক্তিক ও ধারালো সমালোচনা। বিশেষ করে লেখার ভেতর বেখাপ্পা কোনো ইংরেজি শব্দ ঢুকে গেলে রক্ষে নেই। দল ও লেখার সাবলিলতা নস্ট হওয়ার শঙ্কায় মাঝে মাঝে আমাদের বিপরীতে ষড়যন্ত্রের নকশাও আঁকতে ছাড়েন না তিনি।কী সেই ষড়যন্ত্র?আপাতত না হয় গোপনই রাখলাম।
সব বলে দিলে শেষে মামলা পর্যন্ত গড়াতে পারে।তবে এতটুকু বলে রাখা প্রয়োজন, সাবরিনার এই ফোন কলেও আমি গভীর ষড়যন্ত্রের লক্ষণ পেয়েছি। তিনি মূলত আমাদের দলটাকে জনসমাগমের ভেতরেই আটকে রাখতে চাইছিলেন। অর্থাৎ কোনোক্রমেই যেন নির্জন অন্ধকারমুখো না হই। কিংবা নৌকা ভাড়া করে যেন বিপজ্জনক এলাকায় না যাই। এর আগে পারিবারিক ভ্রমণে তিনি চাঁদপুর ঘুরে গেছেন। নিজের চোখে দেখেছেন ¯্রােতের ভয়ঙ্কর ঘূর্ণি।সুতরাং আমাদেরকে নিরাপদ যায়গায়ই অবস্থান করতে হবে।শহরের সবচেয়ে কোলাহলমুখর স্থানে নিরাপদে ঝিমুতে ঝিমুতে না হয় একটি রাত পার করে এলাম। কিন্তু সেই রাতের বর্ণনা লিখতে গেলে ঝিমুনি ছাড়া আর কোনো রসদ খুঁজে পাওয়া যাবে কী?ওসব বিত-া এড়িয়ে আমি আবার ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো বলতে শুরু করলাম। তিনি বাধা দিলেন।
তারপরও কিছুটা বলতে পারলাম। বললাম অবাক বালক শুক্কুর আলীর কথা। তিনি জানতে চাইলেন, এখনো আমরা তার পিছু পিছু ঘুরছি কি না।আমি আশ্বস্ত করলাম- না…হ।সাবধান ওইসব পোলাপান কিন্তু সুবিধার হয় না। পেছনে ঘুরাইতে ঘুরাইতে আপনাদের বিপদে ফেলবে।কে এই শুক্কুর আলী?শুক্কুর আলীর সাথে পরিচয় সেই সদরঘাট থেকে।সময় তখন সাড়ে চারটা, ৩ অক্টোবর ২০১৩, সিঁটি বাজিয়ে টার্মিনাল থেকে বিচ্ছিন্ন হলো আমাদের লঞ্চ ঈগল। নাক ঘুরিয়ে বুড়িগঙ্গার জল কেটে রওয়ানা হয়েছে চাঁদপুরের উদ্দ্যেশ্যে। লঞ্চের ছাদে একটি গোল টেবিলকে কেন্দ্র করে ছয় ছয়টি চেয়ারে গোল হয়ে বসেছি নিশিদলের ছয় সদস্য। মজার ব্যপার হলো আমাদের দলের সদস্য সংখ্যা ছয়, আর এই টেবিল ঘিরে ছয়টি চেয়ারই রয়েছে। চেয়ারগুলো ছাদের সাথে আটকানো। টেবিলের মাঝ বরাবর একটি বড়সর ছাতার কাঠামো ওপরের দিকে ছড়িয়ে গেছে। এই কাঠামোসর্বশ্ব কাঙ্কালছাতার নিচে বসে আছি আমরা ছয়জন- আমার ডান দিকে নিশিপ্রার্থী আহসান সজিব। তারপর একে একে নিশাচর সাইমুম সাদ, নিশাচর জাফর হায়দার তুহিন, নিশাচর মফিজুর রহমান রোমন এবং নিশিপ্রার্থী আহমদ আমিন।আমাদের মাথার ওপর তখনো বিকেলের পড়ন্ত রোদ। এই রোদঝলমল বুড়িগঙ্গায় ঝলমলে চেহারা নিয়েই হাজির হলো শুক্কুর।
তারপর আমাদের দিকে ডান হাতটা বাড়িয়ে ধরলো। টাকা চাইলো। আমরা অবাক হয়ে তাকালাম এই অবাক বালকের দিকে।গায়ে লাল রঙের টি শার্ট, পরনে কালো হাফপ্যন্ট। গোলগাল ফর্সা চেহারা। চোখে তার সারল্যের ঝলকানি। আর মুখে প্রশস্ত একটি হাসি।কী এক অদ্ভ’ত কারণে সে কেবল হাসছে। আমাদের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে টাকা দাবি করছে ঠিকই, কিন্তু মুখে এতটুকু মলিন ভাব নেই। নেই কোনো অসহায়ত্বের ছাপ।ফিক ফিক করে হাসতে হাসতেই বাড়িয়ে দেয়া হাতটা টেবিলের ওপর মেলে ধরলো। অবাক বালকের অবাক হাসি দেখে চঞ্চল হয়ে উঠলাম সবাই। আমাদের সমস্ত মনযোগ গিয়ে পড়লো ওর ওপর। সেও অন্যসব ভুলে আমাদের সাথেই নিবির হয়ে এলো।নাম কী তোর? জিজ্ঞেস করলেন আহমদ আমিন।ঝটপট উত্তর- শুক্কুর আলী।এবার শুক্কুর আলীকে কাছে ডাকলো তুহিন- বয়স কত?ডান হাতের তর্জনি আঙ্গুলটি উঁচু করে দেখালো, অর্থাৎ এক বছর।নিশ্চিত হওয়ার জন্য আবার বয়স জিজ্ঞেস করলো সাদ।আবার আঙ্গুল উঁচু করলো সে। সাথে সাথে মুখেও উচ্চারণ করলো- এক বছর।খিক খিক করে হেসে উঠলো পুরো নিশিদল। হাসলো শুক্কুর আলীও।
হাসতে হাসতেই আমাদের ঘিরে একটি চক্কর দিলো। অর্থাৎ বুঝিয়ে দিলো, আমাদেরকে পছন্দ হয়েছে তার।আমাদেরও ভালো লেগেছে এক বছর বয়স দাবিদার আট-নয় বছর বয়সি শুক্কুর আলীকে। সম্ভবত এ কারণেই আমাদের সম্বোধন পরিবর্তন হয়ে ’তুই’ থেকে ‘তুমি’তে এলো।সজিব পকেট থেকে দশ টাকা বের করে ধরিয়ে দিলো ওর হাতে। দুই টাকার দু’টি নোট দিলেন আহমদ আমিন। খুব যতœসহকারে টাকাগুলো গুনে গুনে হাফপ্যন্টের পকেটে রাখলো শুক্কুর। তারপর ফকফকে সাদা দাঁত বের করে আবারো একঝলক হাসলো সে।ততক্ষণে রোমনের ক্যমেরা চালু হয়ে গেছে। বেশ কয়েকটি ছবি তোলা হলো। বিষয়টা তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করলো শুক্কুর। তারপর ক্যমেরার ভেতর নিজের ছবিগুলো দেখার জন্য পরম নিশ্চিন্তে রোমনের পাশ ঘেঁষে দাঁড়ালো।সাইমুম সাদ চেয়ার থেকে ওঠে এসে শুক্কুর আলীকে কোলে করে টেবিলের ওপর বসিয়ে দিলো। আমরা হাসছি। তার মুখেও লজ্জ্বার হাসি। এর আগে সম্ভবত অমন করে সবার মধ্যমনি হয়ে টেবিলে বসার সৌভাগ্য হয়নি তার।এবার লঞ্চের ছাদে বসা অন্যান্য যাত্রীদের দৃষ্টিও এই অবাকবালকের দিকে। সবাই মিট মিট করে হাসছে। জবাবে সে কয়েক সেকেন্ডের জন্য মাথা নিচু করে রাখলো। তারপর হঠাৎ করে মুখ তুলে বিটকেলে ধরনের একটা হাসি দিয়েই স্বাভাবিক হয়ে হলো।নিজ থেকেই কথা বলতে শুরু করলো আমাদের সাথে।
রোমন ও সজিবের সেলফোন দুটো নিয়ে ওর ভীষণ কৌতুহল। এ দুটোর দাম কতো? একবার কেনার পর কতদিন টেকে? কিভাবে ছবি তোলে?টেবিলে বসে থেকেই ফোন দুটোকে উল্টে পাল্টে দেখছে, আর আনমনা হয়ে আমাদের প্রশ্নের জবাব দিচ্ছে শুক্কুর।বাড়ি কোথায়?চাঁন্দপুর।চাঁন্দপুর না, চাঁদপুর?কইলাম না চাঁন্দপুর।কী কর?এউগুলাই করি।এইগুলা কী?লঞ্চে ঘুরি।লঞ্চে ঘুরলে কী লাভ?পইসা পাই।বাড়িতে বাবা মা নেই?থাকবো না কেন?কী করে ওরা?কাম করে।প্রশ্নে প্রশ্নে বিরক্ত হয়ে এলো শুক্কুর। তাই আর প্রশ্ন না করে ওকে ওর মতো থাকতে দিলাম আমরা। টেবিল থেকে নেমে দাঁড়ালো সে। এবার ঝুঁকে এসে টেবিলে রাখা পত্রিকার ছবি দেখতে শুরু করলো।শুক্কুর আলীকে পাশে রেখেই আমরা দৃষ্টি দিলাম নদীর দুই তীরে। দৃষ্টি দিলাম বললে ভ’ল হবে, আমাদের দৃষ্টি কেড়ে নিলো কাশফুল। একেকটি জনবহুল এলাকা পেরিয়েই লম্বা এলাকাজুড়ে কাশবন। সাদা আর সাদা। ছবির মতো দৃশ্য। কোথাও কোথাও ঝাঁকড়া চুল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পুরনো বটগাছ। এরা ইতিহাসের স্বাক্ষী। এদের মুখ খুলে দিলে পই পই করে হিসাব দিতে পারবে বুড়িগঙ্গা দিয়ে কত জল বয়ে গেল।এদের স্বাক্ষী রেখেই সরগরম হয়ে উঠেছে জনপদ। গড়ে উঠেছে শিল্পকারখানা, কংক্রিটের স্তুপ। আর গড়ে উঠেছে ইটভাটা। ইটভাটার এই আকাশচুম্বি জ্বালামুখগুলোর কাছে বটগাছগুলো নিতান্তই অসহায়।বটগাছ, কাশফুল আর যান্ত্রিক শিল্পভ’মি দেখতে দেখতেই আমরা ফতুল্লা পেরিয়ে গেলাম। ঘড়ির কাঁটা তখন পাঁচটা বেজে সাত মিনিটে।
হঠাৎই মনে হলো শুক্কুরের কথা। তাকিয়ে দেখি কোথায় যেন চলে গেছে।নাহ। একেবারে চলে যায়নি। মিনিট তিরিশেক পর আবার হাসতে হাসতে এসে উপস্থিত হলো শুক্কুর। তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। আমাদের মাথার ওপর ছড়ানো ছাতার কঙ্কালটায় জ্বলে ওঠেছে বৈদ্যুতিক বাতি। কাশফুলের শুভ্রতা তখনো হারিয়ে যায়নি।হারায়নি শুক্কুরের বিটকেলে হাসিটাও। এবার ওর মেজাজ আগের চেয়ে ফুরফুরে। মনে হলো সাত রাজার ধন জয় করে এসেছে। চটাঙ চটাঙ করে কথা বলছে। লঞ্চের কোথায় কী হচ্ছে বর্ণনা দিতে শুরু করলো। কে তাকে কী খেতে দিয়েছে তাও জানালো। এই তিরিশ মিনিট সময়ের মধ্যে সে এক বোতল জোস পেয়েছে। নিজে একটি ডিম কিনে খেয়েছে। ঝালমুড়িওয়ালার কাছ থেকে ঝালমুড়ি, চানাচুর কিনেছে। আর কয়েকজন তাকে কিছু টাকাও দিয়েছে।তাহলে সব খরচাপাতির পর ওর হাতে এখন কত টাকা আছে?ঝট করে হাফপ্যন্টের পকেট থেকে টাকাগুলো বের করলো সে। গুনার পর দেখা গেলো সর্বসাকুল্যে আঠারো টাকা।টাকার পরিমাণ কম বলে মোটেও মন খারাপ নয় শুক্কুরের। টাকা-পয়সা হলো হাতের ময়লা। আজ আছে কাল নেই। কাজেই যখন হাতে টাকা আসে, তা দিয়ে কিছু খেয়ে নেয়া ভালো।শুক্কুর আলীর সারল্যে আবারো গলে গেলাম আমরা। ওর হাতে ধরিয়ে দিলাম দুই টাকার একটি নোট। টাকা নেয়ার প্রতিও ওর অতিরিক্ত আগ্রহ নেই।
ভাবখানা এমন, দিচ্ছি বলেই নিচ্ছে। না দিলেও তেমন কিছু আসে যায় না।অমনোযোগী হয়েই টাকাটা হাত বাড়িয়ে নিয়ে আগের সেই আঠার টাকার সাথে যোগ করলো। তারপর নতুন করে গুনতে শুরু করলো।তুহিন, সাদ আর সজিবের সহায়তায় টাকাশুমারি শেষে শুক্কুর আলী এই সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারলো যে, ওর হাতে মোট বিশ টাকা আছে।শুমারি শেষ হতে না হতেই আরো একটি দুই টাকার নোট বাড়িয়ে দিলো সাদ।সুতরাং আবার প্রথম থেকে গুনতে হবে!নিশিদলের চাপাচাপিতে গুনতে বাধ্য হলো শুক্কুর।এবার সর্বসাকুল্যে বাইশ টাকা।তৃতীয়বারের মতো শুমারি শেষেও সে দুই টাকা পেলো রোমনের কাছ থেকে।আবার সেই শুমারির ঝামেলা?এবার আর বলতে হলো না। নিজে নিজেই গুনতে শুরু করলো সে।তারপর একবার শুমারি শেষ হয়। আরো একজন দুই টাকা করে দেয়।ব্যপারটা এমন পর্যায়ে দাঁড়ালো যে, টাকা গুনলেই টাকা বাড়ে। ব্যপক উৎসাহিত হলো শুক্কুর। সে বার বার টাকা গুনছে, বার বার দুই টাকা করে বাড়ছে।একসময় গুনতে গুনতে তালগোল পাকিয়ে ফেললো। টাকায় টাকায় ভরপুর হয়ে টাকার প্রতি অনীহা তৈরি হলো তার।শুক্কুর আলী টাকা গুনতে গুনতে আমাদের লঞ্চ ঈগল অতিক্রম করলো মুন্সিগঞ্জের মুক্তারপুর সেতু। ঘড়িতে তখন সন্ধ্যা ছয়টা। এর কয়েক মিনিট পরই আমরা তলিয়ে গেলাম অন্ধকারের চাদরে।প্রাণোবন্ত হলো নিশিদল।
আমরা প্রবেশ করলাম নিশিঘোরে। গোটা পৃথিবীতে তখন অন্ধকার। অন্ধকার কেটে চাপা গুঞ্জন তুলে নদীতে ভাসছে ঈগল। আকাশে চাঁদ নেই। আমাদের মাথার ওপর জ্বলছে একটিমাত্র বৈদ্যুতিক বাতি। আর দূরের জনপদ জ্বলছে টিম টিম করে । এ ছাড়া চার’পাশে কেবল কালো আর কালো। নিশিদলের সাথেও যোগ হলো কালো মাত্রা। শুরু হলো ভ’ত নিয়ে ছমছমে আড্ডা। তারপর প্রাসঙ্গিকভাবেই পরিবর্তন হতে থাকলো আড্ডার বিষয়। ভ’ত থেকে বিভ্রম। বিভ্রম থেকে সাইকোলজি। আর সাইকোলজি থেকে প্যরাসাইকোলজি।প্যরাসাইকোলজি হলো সাইকোলজির একটি শাখা। যা অদ্ভ’ত অদ্ভ’ত মনস্তাত্ত্বিক বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করে, যেগুলোর বাস্তব ব্যখ্যা দেয়া এখন পর্যন্ত সম্ভব হয়নি। এই যেমন সজিব বর্ণনা করলো তার জীবনে ঘটে যাওয়া অদ্ভ’ত এক ঘটনার- সে তখন পঞ্চম শ্রেণীর চ’ড়ান্ত পরীক্ষা দিচ্ছে। পরদিন গণিত পরীক্ষা। গণিতে একশোতে একশো পাওয়ার ইচ্ছে তার অনেক দিনের। ছাত্র হিসাবে সে লোকজনের কাছে মেধাবী বলেই পরিচিত। তাই সবাই আশা করছে এবার সোনার ছেলে সজিব গণিতে একশো নাম্বার পেয়ে দেখাবে।
এই বাড়তি চাপ মাথায় নিয়ে নাওয়া খাওয়া হারাম হয়ে গেলো বেচারা সজিবের। যতটা না পড়তে পারছে তার চেয়ে বেশি দুশ্চিন্তা করছে। এভাবে দুশ্চিন্তায় দুশ্চিন্তায় ঘুমিয়ে গেলো সে।পরীক্ষার আগের রাতের ঘুম বলে কথা, এটা ওটা স্বপ্ন দেখতে শুরু করলো সজিব। সব কথা ওর মনে নেই। তবে যেটা মনে রাখার প্রয়োজন সেটা ঠিকই মনে রাখলো।সেই রাতে সে স্বপ্নের ভেতর গণিত পরীক্ষার প্রশ্ন দেখেছিলো। পুরো প্রশ্নটা মুখস্তও করে রেখেছিলো। সকালে ওঠে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলায় দুলতে দুলতেই প্রশ্নের সমাধানগুলো একবার অনুশীলনও করেছিলো সজিব।তারপর কী হলো?পরীক্ষার হলে সেই স্বপ্নের প্রশ্নপত্রটাই তার হাতে এলো।সজিব গণিতে একশো তে একশো পেলো। পাড়া প্রতিবেশির কাছে তার নাম হলো। কিন্তু আসল ঘটনাটা তখনকার মতো চেপেই রাখলো সে। গোমর ফাঁস করে দিলে লোকজন তার মেধা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে।ছোটবেলায় না হয় মানসম্মানের ভয়ে বলেনি সজিব। কিন্তু বড় হয়েও এটা চাওড় করেনি কেন?সেই মানসম্মানের ভয়েই।লোকজন তাকে পাগল বলে গালাগালি করতে পারে। আর কাছের লোকজন পাগল না বললেও, গপ্পোবাজ বলে খাটো করতে পারে।নিশিদল তাকে পাগলও বললো না, গপ্পোবাজ বলে খাটোও করলো না।
বরং এই ঘটনাটাকে বিশ্লেষণ করলো প্যরাসাইকোলজির যুক্তিতে।বাস্তবে এমন ঘটনা অহরহই ঘটছে। কিন্তু এগুলোকে অনেকেই বিভ্রম বা ভ’ল বলে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি। অনেকসময় এড়াতে গিয়েও এড়াতে পারি না। কারো কারো জীবনে এসব অদ্ভ’ত ঘটনা আস্টেপৃষ্টে জড়িয়ে থাকে।তাহলে কী সবই ভ’ল?মোটেও না। কেউ প্রচন্ডভাবে কোনো কিছু কামনা করলে সেটা অনেক সময় যুক্তিকে অগ্রাহ্য করে বাস্তবেও পরিণত হতে পারে। একজনের মাথা থেকে অন্যজনের মাথায় সঙ্কেত পাঠানোও সম্ভব। হতে পারে সেটা তার চেতন মনে কিংবা অবচেতন মনেও।এমনও হতে পারে কারো একটি ইচ্ছের সঙ্কেত সম্পূর্ণ অপরিচিত একজনকেও প্রভাবিত করছে। একজনের ইচ্ছেটাকে বাস্তবায়ন করার জন্য সক্রিয় হয়ে উঠছে অন্যজন।এই যেমন সাবরিনার মনস্তাত্ত্বিক ষড়যন্ত্রের কবলে পড়ে সাড়ে সাত লাখ টাকা খোয়ালো সজিব।ষড়যন্ত্রের বিষয়টি চেপে রাখতে পারলাম না বলে দুঃখিত। মূলত সত্য কখনো চেপে রাখা যায় না। ছাই দিয়ে মাছ ঢেকে রাখা যেমন কষ্টকর, তেমনি মুখে লাগাম দিয়ে সত্যকে আটকে রাখাও দুঃসাধ্য ব্যপার। আর এতটুকু যখন মুখ ফসকে বলেই ফেলেছি তো ব্যপারটা খোলাসা করে দেয়াই ভালো। তবে সজিবকে অনুরোধ করবো মামলা করার বিষয়টি একটু শিথিল দৃষ্টিতে দেখতে।সজিব ও সাবরিনার পরষ্পরিক পরিচয় নেই। তবুও ঘটে গেলো ঘটনাটা!কিভাবে?বলছি সে কথাই- নিশিদলকে নিয়ে ষড়যন্ত্রের বিস্তর এক নকশা আঁকলেন সাবরিনা। কোনোভাবেই নিশিদলের সদস্য সংখ্যা পাঁচের ওপর তুলতে দেয়া যাবে না। এতে নানাবিধ সমস্যা। রাতের অন্ধকারে একটি ভারি দল নিয়ে বিচরণ করলে মানুষের কৌতুহল তৈরি হবে। যে কেউ ভ’ল বুঝতে পারে। তারপর স্থানীয় লোকজন সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে একটা কিছু করেও বসতে পারে। তাছাড়া বেশি চরিত্রের সমাগম ঘটালে লেখাগুলোর সাবলিলতাও নস্ট হতে পারে।নিশিদল সাবলিলই থাকতে চায়। আর সাবলিলতার স্বার্থেই ‘বাধ্যবাধকতা’ শব্দটির অস্তিত্ব দলের অভিধানে নেই। তারপরও শৃঙ্খলার স্বার্থে কিছু বাধ্যবাধকতা থেকেই যায়।
এসব বাধ্যবাধকতার পরীক্ষা উৎরে এবার চার নিশাচরের সাথে নিশিপ্রার্থী হিসাবে যোগ হওয়ার কথা আহমদ আমিন ও সজিবের।অন্যদিক থেকে হুমকি দিলেন সাবরিনা, দলকে পাঁচজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার লক্ষ্যে প্রয়োজনে তিনি সাধনায় বসবেন।শেষ পর্যন্ত কাউকে আটকাতে পারলেন না সাবরিনা। সদরঘাটে সজিবের উপস্থিতিসহ দলটি যখন পাঁচজনের সীমা অতিক্রম করলো তখন তিনি আত্মপক্ষ সমর্থন করে একটি কৈফিয়ত দিলেন, সময়ের অভাবে নাকি তিনি ঠিকমতো সাধনায় মনযোগি হতে পারেন নি।আর এ কারণেই সজিবকে আটকে দেই দেই করেও আটকানো সম্ভব হয়নি। অবশ্য পরবর্তীতে দলের ভেতর সজিবের উপস্থিতির বিষয়টিকে তিনি ইতিবাচক দৃষ্টিতেই গ্রহণ করেছিলেন। কারণ তিনি জানতে পেরেছিলেন সজিবের সেলফোনটি কৈ মাছের প্রাণ। অর্থাৎ আমারটার মতো নিমিশেই চার্জ উধাও হয়ে যায় না। বিশেষ করে নিশিদলের ট্রিপে বের হলে আমার সেলফোনটিকে কোনোভাবেই মধ্যরাত পর্যন্ত টিকিয়ে রাখতে পারি না।
সে কারণেই দলের অন্য সদস্যদের নাম্বারগুলোও তাকে দিয়ে রাখি। কিন্তু একটা সময়ে এসে যেই লাউ সেই কদু। অর্থাৎ কারো নাম্বারেই সংযোগ পাওয়া যায় না। অন্যসব ট্রিপের মতো এবারও যথারীতি সবার নাম্বার তাকে দিলাম। দিলাম কৈ মাছের প্রাণ সেলফোনের অধিকারি সজিবের নাম্বারটিও। তিনি আমার এবং সজিবের প্রতি প্রীত হলেন। দলের সদস্য সংখ্যা নিয়ে তার সাথে আর কোনো বিরোধ রইল না। কিন্তু মাঝখান থেকে খামোখাই সজিবের সাড়ে সাত লাখ টাকা উধাও হয়ে গেলো!ঘটনাটা তখনো জানতাম না আমরা-নিশিদল ঢাকায় ফেরার পথে সজিব জানালো, ওই দিন দুপুরেই তার ব্যবসার সাড়ে সাত লাখ টাকা মেরে দিয়ে এক ঠগ পাত্তারি গুটিয়েছে।তারপরও সে নিশিদলে এসেছে। টাকার শোকে সন্তপ্ত সজিবকে অন্তত সেই মূহুর্তে দলে নিতে চাইবো না বলে, ঘটনাটা আমাদের জানায়নি।পরে জানতে পেরে দুই-এ দুই-এ চার মিলে গেলো।সাবরিনার সাধনার কারণেই সঙ্কেত চলে গিয়েছিলো সজিবের পরিচিত সেই ঠগের কাছে। ঠগ সক্রিয় হলো। অতঃপর সাড়ে সাত লাখ টাকা মেরে ভাগলো। সজিব বিমর্ষ হলো। আর এমন বিমর্ষ অবস্থায় নিশিদলের সাথে ট্রিপে না যাওয়াটাই স্বাভাবিক।সম্ভবত ঠিক সেই মুহুর্তেই সময় স্বল্পতার কারণে সাধনায় ছেদ পড়লো সাবরিনার। আর সজিবও ঘোর কাটিয়ে উল্টো সিদ্ধান্ত নিলো দলের সাথে যাওয়ার।ধৈর্য্য ও অধ্যবসায়ের অভাবে তীরে এসে তরী ডুবালেন সাবরিনা।
আমাদের তরী ঈগল কিন্তু মাঝপথে ডুবে যায়নি, আমরা প্যরাসাইকোলজির বিভিন্ন শাখা-উপশাখায় মগ্ন থাকতে থাকতেই ভীড়লো চাঁদপুর ঘাটে। রাত তখন ৮টা বেজে ৩৩ মিনিট।তাড়াহুড়ো করে নামলাম আমরা। একনজর দেখে নিলাম জেটি। একটি কাঠের সেতু দিয়ে স্থলের সাথে সংযুক্ত জেটিটি। লম্বা জেটির ওপরই কয়েকটি কাউন্টার। আর কিছু খোপ খোপ ঘর।আমরা জেটি থেকে উঠে এলাম স্থলে। সরগরম ঘাট। লোকে লোকারন্য। রিকশা, সিএনজি ডাকাডাকি করছে। চলছে যাত্রীদের মালামাল নিয়ে টানাটানি।কিন্তু আমাদের গন্তব্য কোথায়?সবাই ভেতরে ভেতরে যা কামনা করছিলো, সেই সিদ্ধান্তই জানালো তুহিন- আমরা এখন হালকা খাবার খাবো।কিন্তু কী খাবো, কোথায় খাবো?চাঁদপুরের কালীবাড়ি এলাকায় ‘ওয়ান মিনিট মিস্টির দোকান’-এ। জানালো রোমনতার এক সহকর্মীর কাছ থেকে তথ্য নিয়ে এসেছে, এ দোকানটিতে ছোট আকারের মিস্টি পাওয়া যায়, খেতে সুস্বাদু।বাহ, পরাটা দিয়ে পুঁচকে মিস্টি!একবাক্যে রাজি হয়ে গেলাম সবাই।তারপর রিকশা দাম করি, মোটরচালিত অটোরিকশা দাম করি। দাম করতে করতে একটি অটোরিকশার সাথে বনিবনা হলো। আমরা উঠলাম কালিবাড়ি যাবো বলে। রিকশা স্টার্ট নিলো।কিন্তু হঠাৎই আমাদের বাহনের সামনে এসে হাজির শুক্কুর আলী। অনুরুধ করলো তাকেও রিকশায় তুলে নেয়ার। এতক্ষণ যার কথা আমরা ভ’লেই গিয়েছিলাম। সে আমাদের ভ’লতে পারেনি। আমরা অনুরুধ রাখলাম। শুক্কুরকে তুলে নিলাম সাথে। ওর বাড়িও কালিবাড়ি এলাকায়। আমরা অটোরিকশায় করে না নিলে হেঁটেই যেতো।তৃপ্তির হাসি হাসছে শুক্কুর। কিন্তু এই হাসিটা বন্ধ হয়ে যেতে বাধ্য হলো আহমদ আমিনের কথায়। তিনি সবাইকে জানিয়ে দিলেন, আমরা রাতের খাবার শুক্কুরের বাড়িতেই খাবো।এতটুকু উপকারের বিনিময়ে এতবড় মাশুল চাইবো ভাবতেও পারেনি সে।মুখটা কালো হয়ে এলো ওর। দুলতে শুরু করলো শঙ্কায়। আমরা যদি সত্যি সত্যিই ওর বাড়িতে চলে যাই, তাহলে এতগুলো অনাহুত অতিথিকে সামাল দেয়া তার পক্ষে অসম্ভব।সবাই যখন ওর বাড়িতে খাওয়ার ব্যপারে একমত হলাম, শুনেও না শোনার ভান করলো শুক্কুর। বেচারার চেহারাটা তখন দেখার মতো বিব্রতকর হয়ে উঠেছিলো। মনে হলো সম্ভব হলে চলন্ত রিকশা থেকে লাফিয়ে পড়বে।লাফিয়ে সে পড়েনি। কিন্তু আমাদের বাহনটি যখন কালিবাড়ি এসে থামলো, তখন জোর করেও তাকে আটকে রাখা যাচ্ছিলো না।
কৈ মাছের মতো পিছলে পাছলে সটকে যেতে চাচ্ছিলো।কিন্তু সাইমুম সাদের হাতের বাঁধন থেকে মুক্তি পাওয়া কঠিন। তাছাড়া তুহিন আর রোমন ততক্ষণে ‘ওয়ান মিনিট মিস্টির দোকান’ এর সন্ধান করছে।মিস্টির দোকানের নাম উচ্চারণ করার পর শুক্কুরকে আর জোরাজুরি করতে হলো না। নিজেই জানালো এই দোকানটি সে চেনে। সত্যি সত্যিই মিনিটখানেকের ভেতর আমাদের নিয়ে হাজির করলো ‘ওয়ান মিনিট’ এর সামনে।জিভে জল এসে গেলো। আহ, পুঁচকে মিষ্টিগুলো খেতে মন্দ হবে না।কিন্তু ওয়ান মিনিট মিস্টির দোকানের ভেতরে প্রবেশ করে হতাশ হতে আমাদের ওয়ান মিনিট সময়ও লাগলো না। দোকানে মিস্টি নেই।ধ্যত্তেরি ছাই।তারপর ছয়জন ছয়টি হতাশ ও বিধ্বস্ত জিভ নিয়ে শুক্কুরের পিছু নিলাম। সে আমাদেরকে নিয়ে হুট করে একটি হোটেলে ঢুকে গেলো। দ্বিধায় পড়লাম, কেমন হবে এখানকার খাবার?কিন্তু খাবার মুখে নিয়ে সবাই শুক্কুরের প্রশংসায় পঞ্চমুখ।সবার সামনেই রুটি। আমি আর রোমন রুটির সাথে ডাল নিয়েছি। তুহিনের সামনে হালুয়া। সাদ, আহমদ আমিন এবং সজিবের পছন্দ মিস্টি। আর শুক্কুরের পছন্দ অবশ্যই মিস্টি। সে নিজে মিস্টি খাচ্ছে এবং অপরকে মিস্টি খেতে উৎসাহিত করছে।
কিন্তু আমি আর রোমন কেন ডাল দিয়ে খাচ্ছি তা বোধগম্য নয় শুক্কুরের। আমার দিকে আঙ্গুল তুলে একটা অবজ্ঞার হাসি হেসে অন্যদের জিজ্ঞেস করলো- ডাইল খায়! ডাইল দিয়া খাইয়া কী মজা পায়?একচোট হাসলো সবাই। এতে মোটেও বিব্রত হলো না শুক্কুর। তার মনে প্রশ্ন থেকেই গেলো, বাড়িতে তো সবসময়ই ডাল খাওয়া হয়। হোটেলে মিস্টি রেখে ডালের মতো গড়পড়তা খাবার বেছে নেয়ার পক্ষে কোনো যুক্তিই খুঁজে পাচ্ছে না সে।খেতে খেতেই খাওয়ার ব্যপারে আরো সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিলো আমাদের। উদাহরণ দিলো নিজের সচেতনতার। আচমকা সে তার ডান হাতটা ভি আকৃতির মতো বানিয়ে পেশিটা শক্ত করে ধরলো। টান টান হয়ে পেশির ভেতর থেকে ডিমের মতো একটা পি- ফুলে উঠলো। তারপর বাম হাত দিয়ে এই পিন্ডটার ওপর দুইবার চাপড় বসালো- এই যে দেখতাছেন না ডিম। এইডা লঞ্চে বইসা খাইছি।তারপর গলার দিকটায় ইশারা করে দেখালো, সেই ডিমটাই গলার ভেতর দিয়ে পেটে চালান হয়েছে। তারপর পেট থেকে এই হাতের পেশিতে এসে স্থির হয়েছে।কাজেই খেতে হলে সবসময় ভালো কিছু খেতে হয়।অবাক বালক শুক্কুরের খাওয়া এবং খাওয়ার ব্যপারে গবেষণা দেখে আমরা রীতিমতো অবাক হলাম। আরো অবাক হওয়ার মতো তথ্য দিলেন তার মা।হোটেলে খাওয়া শেষ করে আমরা পাশেই চাঁদপুর কোর্ট রেলস্টেশনে গেলাম।
সেখানেই দেখা শুক্কুরের মা মনি আক্তারের সাথে। মনি আক্তার থাকেন স্টেশনের কাছাকাছিই একটি ছাপড়াতে। স্টেশনকেন্দ্রিক তার জীবিকা। এখানেই ফুট ফরমাশ খাটেন। আবার লোকের বাড়িতে কাজ করেন। ওর বাবাও স্টেশন কেন্দ্রিকই শ্রমিকের কাজ করেন।ওরা দুই ভাই, দুই বোন। দুই বোন ওর চেয়ে বড়। আর ওর ছোট ভাইটাকে দেখলাম স্টেশনেই দৌড়াদৌড়ি করছে। শুক্কুরের মতোই চঞ্চল। মায়ের সাথে দুই ভাইয়ের একসাথে ছবি তোলার সময়ও সে স্থির থাকতে চাইছে না। ছবি তোলার জন্য ওর মা ওকে খেলা থেকে ধরে এনেছে। তাই সে আমাদের প্রতি প্রচ- বিরক্ত।নিজের গোমর ফাঁস হয়ে যাওয়ায় কিছুটা বিরক্ত হলো শুক্কুরও। আমাদের প্রতি নয়, ওর মায়ের প্রতি। শুক্কুরের মা মনি আক্তার যা বললেন, তাতে শুক্কুরকে একটা বড়সর খাদক বলা যায়।তিনি জানালেন, সে শুধু খায় আর খায়। পয়সাওয়ালা লোকের সন্তানও তার মতো খেতে পারে না।শুক্কুর প্রায় প্রতিদিন লঞ্চে করে ঢাকায় যায়। আবার সেই লঞ্চে করেই চাঁদপুর ফিরে। লঞ্চে আমাদের মতো অনেকেই তাকে কাছে টানে। এটা ওটা খেতে দেয়। টাকা পয়সা দেয়।কিন্তু একটি টাকাও সে তার মা কিংবা বাবার হাতে তুলে দেয় না।
প্রতিদিনের আয় প্রতিদিনই খেয়ে শেষ করে শুক্কুর।কী খায় সে?অস্বাভাবিক কিছুই না।বেশি বেশি ডিম খায়। ভাজা পোড়া খায়। ঝালমুড়ি, চানাচুর। পথে ঘাটে যা পায়, তাই খায়।মাঝে মাঝে ইচ্ছে হলে ছোট ভাইটার জন্য কিছু উচ্ছিস্ট নিয়ে আসে।শুক্কুর আলীকে স্কুলে ভর্তি করানোর চেস্টা করেছে মা। কিন্তু তার কেবল খাওয়ার নেশা। আর খেতে হলে স্কুলে নয়, যেতে হবে লঞ্চে। তাই লঞ্চই ওর স্কুল। লঞ্চই ওর নেশা।এই খাওয়া আর লঞ্চের নেশা থেকে কেউ ফেরাতে পারে না শুক্কুরকে। না তার বাবা, না মা। চোখে চোখে রাখলেও চোখ ফাঁকি দিয়ে ঘাটে চলে যায়। মাঝে মাঝে রাত দুইটা তিনটায়ও বাড়ি ফেরে।অবাক বালক শুক্কুরের অধ্যায় সমাপ্ত করে আমরা গেলাম ইলিশ মাছের আড়তে। কোর্ট স্টেশন থেকে রেল লাইন ধরে বড় স্টেশন। তারপর এর বিপরীতেই ইলিশের আড়ত। আড়ত থেকে সোজা একটি ঢাল নেমে গেছে ডাকাতিয়া নদীতে। এই নদী হয়েই প্রতিদিন এক দেড় হাজার মন ইলিশ আসে আড়তে।আমরা যখন প্রবেশ করেছি, তখন প্রায় ঝিমিয়ে এসেছে আড়ত। পাইকাররা চলে গেছে। আড়তদাররা ইলিশ গোটানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। তবুও কয়েক জায়গায় বেচাকেনা হচ্ছে। একনজরে দেখলাম হাজার হাজার রুপালি ইলিশ। দেশের বিভিন্ন যায়গায় ইলিশ ধরা পড়লেও চাঁদপুরের ইলিশের আলাদা খ্যাতি রয়েছে।এখানকার অনেক মানুষই ইলিশ ব্যবসার সাথে জড়িত।
ধারণা করা হয় চাঁদপুর নামটা চাঁদ সওদাগর নামে এক বনিকের নামানুসারেই হয়েছে। আগে এর নাম ছিলো জুবকী বাজার। দ্বীপের মতো এ এলাকাটি ১৮৫৮ সালে থানা এবং ১৮৭৮ সালে মহকুমা হয়। আর জেলা হয় ১৯৮৪ সালে। পুরো চাঁদপুর শহরটিকে ঘিরে রেখেছে ডাকাতিয়া। এ নদীটি পশ্চিম দিকে গিয়ে মিশেছে পদ্মার সাথে। এর একটু দক্ষিণেই মেঘনা।নদী বেস্টিত এ জেলা শহরটিও ভাঙনের কবলমুক্ত নয়। জেলার অন্যান্য এলাকার মতো শহরেও আঘাত হানে ভাঙন। সর্বশেষ ২০০০ সালের দিকে শহরের লঞ্চ ঘাট, বড় স্টেশন ও আড়ত এলাকার ভাঙনের চিহ্ন এখনো রয়ে গেছে।আমরা আড়তের সামনের দিকটায় পায়চারি করে চলে গেলাম পেছনে। একেবারে ডাকাতিয়ার ঢালে। ওখানেও মানুষের সরগরম যাতায়াত।একটি চায়ের দোকানে বসলাম। দোকানি চা তৈরি করছে, আর আমরা কথা বলছি আড়ত কেন্দ্রিক যাদের জীবিকা এমন কয়েকজনের সাথে।একজনের নাম মোফাজ্জল। তিনি জানালেন এই আড়ত মূলত চাঁদপুরের ইলিশের জন্য বিখ্যাত হলেও, এখানে মাছ আসে হাতিয়া, সন্দ্বীপ থেকেও।চাঁদপুরের মাছগুলো সাধারণত ধরা হয় শহর হতে একটু দূরে পদ্মা, মেঘনা এবং ডাকাতিয়া নদীর সঙ্গমস্থল থেকে। এছাড়া হাতিয়া ও সন্দ্বীপ এলাকা থেকে এখানে মাছ আসে নৌকায় এবং গাড়িতে করেও। বিশেষ করে হাতিয়ার মাছগুলো ডাকাতের ভয়ে গাড়িতে করেই বেশি আসে। আর রাঙ্গাবালি, কুয়াকাটা থেকে ধরা মাছগুলো আসে ট্রলারে করে।দোকানি চা বানাতে বানাতেই আমাদের প্রতি কৌতুহলি হয়ে উঠলো অনেকেই। কথা বললেন, তথ্য দিলেন বেশ কয়েকজন। এদেরই একজন মো: রফিক। মাথায় টুপি, গলায় মাফলার পেঁচানো। আর গায়ের রঙটা কুঁচকুঁচে কালো। বয়স বিয়াল্লিশ-তেতাল্লিশ হবে। তাকে দেখেই মনে হলো তিনি মোটামোটি বিচার-বিবেচনা করে কথা বলেন।
মোঃ রফিক চায়ে চুমুক দিতে দিতে অনেক তথ্যই দিলেন আমাদের। বললেন ইলিশ ধরার বিত্তান্ত ও জেলেদের রসায়ন।সাগরে ইলিশ ধরার একটি নৌকার পেছনে দেড় লাখ টাকার মতো খরচ হয়। একেকটি নৌকায় ১২ থেকে তের জনের মতো জেলে যায়। সাগরে থাকতে হয় গড়পড়তায় ১৫ দিনের মতো। নৌকার ভেতরই খাবার-দাবারসহ জরুরি সবকিছুর আয়োজন থাকে। ইলিশ মাছ সবসময় পাওয়া যায় না। অনেকে ইলিশ না পেয়ে খালি নৌকা নিয়েও ফেরে। ভাগ্য ভালো হলে দুই তিন দিনের মাঝেই ইলিশের ঝাঁকে খেউ দিয়ে নৌকা বোঝাই করে ফিরে আসে জেলেরা। মাছ বিক্রি করে লাভের তিনভাগের দুইভাগ থাকে মালিকের। আর একভাগ নেয় জেলেরা।ইলিশ এবং চাঁদপুরের ব্যপারে কথা বলতে বলতেই মোঃ রফিক আমাদেরকে পরামর্শ দিলেন টোডার মাথা থেকে ঘুরে আসতে।টোডার মাথা কী?প্রশ্ন শুনে একটু ঘাবড়ে গেলেন তিনি। বোঝানোর চেষ্টা করলেন এটি একটি এলাকার নাম। যেখানে দাঁড়ালে নদীর চিত্রটা ভালো করে দেখা যায়।তা বুঝলাম, কিন্তু টোডার মাথা নাম হলো কেন?এবার আরো বিব্রত হলেন- হেইডাতো কইতে পারুম না।
দুই পাশে নদী। মাঝখান দিয়া পাখির ঠোঁটের মতো একটু যায়গা বাইর অইয়া আছে..অর্থাৎ তিনি বলতে চাইছেন, পাখির ঠোঁটের মতো দেখতে বলেই এটাকে ঠোঁটার মাথা, কথ্য ভাষায় টোডার মাথা বলা হয়। আবার এ যায়গাটা ছেঁড়া-টোডা বলেও হয়তো টোডার মাথা বলা হতে পারে।রাত তখন এগারটা। ইলিশের আড়ত থেকে বেরিয়ে আমরা রওয়ানা দিলাম টোডার মাথার উদ্দেশ্যে। বড় স্টেশনের সামনে থেকে রেললাইন ধরে একটু এগিয়েই একটি স্মৃতিস্তম্ভ দেখতে পেলাম। নাম ‘রক্তধারা’ স্তম্ভের ওপর থেকে তিনটি রক্তের ফোঁটা যেন টপ টপ করে পড়ছে। দেখে মনে হলো এখনি টুপ করে মাটিতে রক্তপতনের আওয়াজ হবে। এটি একটি বধ্যভ’মি, এখানে শহীদ হয়েছেন অগণন মুক্তিযোদ্ধা। এই স্মৃতিস্তম্ভটি কে তৈরি করেছেন, দেখার জন্য ফলক পড়তে শুরু করলাম। কিন্তু কোথাও শিল্পীর নাম লেখা নেই। তবে বড় বড় অক্ষরে লেখা রয়েছে স্তম্ভটি যিনি উদ্বোধন করেছেন তার নাম।রক্তধারা পেরিয়ে আমরা প্রবেশ করলাম একটা অন্ধকার গলিতে। কয়েক কদম দূরত্বের এই গলিটা পেরিয়েই পা রাখলাম টোডার মাথায়।
দৃষ্টিসীমায় ঘুটঘুটে অন্ধকার। চাঁদহীন কালো আকাশ। আকাশের ছাউনির তলায় একপ্রস্থ জমি। জমিতে দাঁড়িয়ে আকাশ স্পর্শ করতে চাইছে কয়েকটি গাছ। অভিবাবকহীন পড়ে আছে দুই-তিনটি চটপটি ফোঁচকার টঙ দোকান। বসার জন্য তৈরি করা হয়েছে কয়েকটি ইট-সিমেন্টের তৈরি বেঞ্চি। অর্থাৎ দিনের আলোতে এই এলাকাটা সরগরম থাকে।আমরা এগিয়ে চললাম। হাতের বা দিকে নদী, ওপারে জ্বলছে টিমটিমে আলো। ডানে অন্ধকার। আর সামনে একেবারে হঠাৎ করেই অন্ধকারের একটি দেয়াল। আমরা সহজেই বুঝে গেলাম, এ দেয়াল বেয়েই টোডার মাথা নেমে গেছে ডাকাতিয়া নদীতে।আমাদের শরীর স্পর্শ করে বয়ে গেলো ঠান্ডা বাতাস। গাছের পাতায় পাতায় শব্দ হলো। মুহুর্তের জন্য শরীরটা শিরশির করে উঠলো। একটা ঠান্ডা গুমোট পরিবেশ। যে কোনো মুহুর্তে আমাদের ওপর লাফিয়ে পড়তে পারে বিপদ।বুঝে শুনে পা বাড়ালাম আমরা। একেবারে মাথার কাছাকাছি এসেই চোখে পড়লো দৃশ্যটা-ঠিক অন্ধকারের দেয়াল ঘেঁষেই একটি বেঞ্চি দখল করে আছে দুই দুটি ছায়ামূর্তি। নিঃশব্দ, চুপচাপ।এরা কারা?এদের পরিচয় নিয়ে এত বেশি মাথা ঘামালাম না। নিজেদের মধ্যে স্বাভাবিক আলাপ-আলোচনা অব্যহত রেখেই স্পর্শ করলাম অন্ধকারের দেয়াল। অবস্থান নিলাম ওদের থেকে দশ পনেরো ফুট দূরত্বের বেঞ্চিটার সামনে।
এখান থেকেই ইট-সিমেন্টের পাটাতনগুলো নেমে গেছে নদীতে। আমাদের থেকে বড়জোর পঁচিশ ফুট দূরত্বের ঢাল পেরিয়েই ডাকাতিয়া নদীর প্রবাহ। কিন্তু অন্ধকারের চাদর আমাদের দৃষ্টি থেকে ঢেকে রেখেছে নদীর জল। কানে এসে ঠেকছে ছলাৎছল ছলাৎছল। এটা ডাকাতিয়ার কান্না। নদীরা এমন করেই কাঁদে। মানুষের রোদ্ররোষে পড়ে কাঁদে। আবার ভাঙনে ভাঙনে মানুষকে ভিটেমাটিছাড়া করে কাঁদে। ওদের জন্মই পাহাড়ের কান্না থেকে। ওরা কাঁদবে এটাই স্বাভাবিক। কাঁদতে কাঁদতে গড়িয়ে পড়বে সাগরে।ডাকাতিয়ার কান্নাকাটিতে নরম হয়ে এলো মন। হু হু করে উঠলো বুক। ইচ্ছে হলো জল ছুঁয়ে দিয়ে সহমর্মীতা জানাই। কিন্তু এই হু হু অনুভ’তির ভেতরও এক ধরনের ভালো লাগা আছে। আমি ডাকাতিয়ার কান্না থামাতে গেলাম না। কাঁদছে যখন, কাঁদুক না।ডাকাতিয়া নদীকে পেছনে রেখে সার করে দাঁড়ালাম আমরা। একটা দলছবি প্রয়োজন। কিন্তু দলের ছয়জনকে ক্যমেরায় আনতে হলে সপ্তম ব্যক্তি ছাড়া হবে না।কী করা যায়?আমি এগিয়ে গেলাম সেই ছায়ামানবদের কাছে। হ্যডফোন লাগিয়ে দু’জনেই গান শুনছে। হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। রুক্ষ রুক্ষ চেহারা। আমার পায়ের শব্দ পেয়েও নির্বিকার রইলো। কী এক গভীর ভাবনায় দু’জনেই বুদ।পর পর দুইবার দৃষ্টি আকর্ষণের চেস্টা করে সফল হলাম। ঝট করে একজন তাকালো আমার দিকে।
পাশেরজন তখনো নির্বিকার।আমি অনুরুধ করলাম একটি ছবি তুলে দেয়ার জন্য। ছায়ামানব কোনো কথা বললো না। বেঞ্চির নিচের দিকটা থেকে পায়ের স্যন্ডেল খুঁজে বের করে ওঠে দাঁড়ালো। তারপর আমাকে অনুসরণ করলো। নিঃশব্দেই তার হাতে দামি সেলফোনটা ধরিয়ে দিলো রোমন। আমি দাঁড়ালাম দলের সাথে। তারপর- ক্লিক, ক্লিক..
কয়েকটা ছবি তোলার পর সেলফোনটা আমার হাতে ফিরিয়ে দিয়ে আবার নিঃশব্দেই ছায়ার মতো ফিরে গেলো সেই ছায়ামানব।তারপর একে একে আমরা নামতে শুরু করলাম ঢাল বেয়ে। আমি ছাড়া সবাই পা বাড়িয়ে ছুঁয়ে দিলো জল। আমি স্পর্শও করলাম না। কিন্তু ওদের পায়ের স্পর্শের পরই ছলাৎছল শব্দটা হারিয়ে গেলো অন্য একটি শব্দের ভাঁজে। একটি লঞ্চের ভেঁপু কানে তালা লাগিয়ে দিলো। টোডার মাথা ঘেঁষেই যাচ্ছে ওটা। লঞ্চবাতির আলোয় ফর্সা হয়ে এলো ডাকাতিয়া। অন্ধকারের দেয়াল কেটে এই প্রথমবারের মতো দেখলাম নদীটাকে। এরপর একটু পর পর লঞ্চ আসছে, যাচ্ছে। ইঞ্জিনের গুঞ্জনে খান খান হচ্ছে রাতের নীরবতা। সেই ছলাৎছল ছলাৎছল শব্দটাও যেনো হারিয়ে গেলো কোথায়!আমি এবং আমরা অলস ভঙ্গিতে বসে রইলাম যে যার মতো। রোমন তখনো পানিতেই। আচমকা সে ক্যমেরায় ক্লিক শুরু করলো। বললো- তোমাদের জীবনের সেরা কয়েকটা ছবি তুলে দিলাম।ক্যমেরায় ক্লিক করতে করতেই আদেশ জারি করলো- যে যেখানে আছো, সবাই ওঠে দাঁড়াও।আমরা তার আদেশ শিরোধার্য্য করলাম। আবার ক্যমেরায় ক্লিক।তারপর স্ক্রিনে যখন নিজেদের ছবিগুলো দেখলাম, অবাক হতে বাধ্য হলাম। ছবিতে একপ্রস্থ রাতজমিনের ওপর এলোমেলো নিশিদল।আরো কিছুক্ষণ অলস বসে থাকতাম সেখানে। কিন্তু বড় ধরনের একটি শঙ্কা এসে জমাট বাঁধলো। ব্যপারটা প্রথম লক্ষ্য করলো রোমন- ছায়ামানবদের দলটা ক্রমেই ভারি হচ্ছে। দুইজন থেকে চারজন।
মিনিট খানেকের মধ্যেই চারজন থেকে ছয়জন। তারপর সাত, আট করতে করতে দশ এ পৌঁছলো।নিশিদলের বিপরীতে এই ছায়াদল কী তাহলে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে?কোনো সম্ভাবনাই উড়িয়ে দেয়া যায় না, মত দিলো তুহিন।যদি সত্যিই রণপ্রস্তুতি নিয়ে থাকে, তবে ওরা যে পরিমাণ সৈন্যসমাগম করছে তার তুলনায় নিশিদলের সৈন্য সংখ্যা অপ্রতুল। তাছাড়া ওরা স্থানীয় বলে বাড়তি একটা সুবিধা পাবে।সুতরাং রণাঙ্গন ছেড়ে পলায়ন করাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ।আমরা রণাঙ্গন থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে নিলাম। অন্ধকার ছেড়ে চললাম আলোর দিকে। আমাদের চলে যেতে দেখে ছায়াদল একটা হোঁচট খেলো। তারপর আর পেছন ফিরে তাকাইনি। তবে ডাকাতিয়ার কান্নাটা আবারো শুনতে পেলাম।এবার আর মন নরম হলো না আমার। ভাবলাম, নদীর কান্নাকে প্রশ্রয় দিয়ে কী লাভ? পৃথিবীতে কত মানুষের কান্নাকেই এড়িয়ে গেছি। বুকে পাষাণ বেঁধে চোখ বন্ধ করে রেখেছি। অথচ মানুষের ভেতর একটি নয়, হাজারটি নদীর প্রবাহ। এই হাজারনদীর কোরাস কান্নাও যেখানে গুমরে বেড়ায়, সেখানে এক নদীর কান্না তো মামুলি।গুমরানো কান্না দেখলাম টাইগার পগলার ছলোছলো চোখে। না, সে অশ্রু বিসর্জন দিয়ে কাঁদছিলো না। কাঁদছিলো তার ভেতরকার হাজারটি নদী। টোডার মাথা থেকে ফিরে এসে একটি মুদি দোকানের সামনে এই পাগলের সাথে দেখা। পরনে প্যঁচানো লাল কাপড়।
উর্ধাঙ্গেও একটুকরো কাপড় জড়ানো। হাতে বিশাল চটের থলে। চুলে জট। থুতনি থেকে বেড়িয়ে এসেছে ধারালো দাড়ি। নাকের নিচে দু’গুচ্ছ গোঁফ। চেহারাটা একনজর দেখলে মনে হবে চীনদেশের কুংফু কারাতে মাস্টারদের মতো। কোমল পানীয় টাইগার পছন্দ করে সে। তাই লোকে তাকে টাইগার পাগলা নামেই চেনে। রাত তখন ১১টা বেজে ৩৪ মিনিট। একটি দোকানের কোনায় তাকে দেখেই কাছে ভিরলাম। তুচ্ছতাচ্ছিল্যের সাথে জিজ্ঞেস করলাম- নাম কী?পাগলা কোনো কথা বললো না। কেবল দুটো আঙ্গুল ঘষা দিয়ে বোঝালো, ওর টাকার ভীষণ প্রয়োজন। আমরা মস্করা করলাম। একরকম পেয়ে বসলাম ওকে। একের পর এক প্রশ্ন করছি। কোনো জবাব নেই। সে চুপ থাকছে এবং আমাদের ওপর বিরক্ত হচ্ছে।আমরাও বিরক্ত হয়ে প্রায় চলেই যাচ্ছিলাম। কিন্তু বিপত্তিটা ঘটালো সজিব। ও হঠাৎ করেই পাগলের আঙ্গুলে কি যেনো আবিষ্কার করলো। আমাকে কাছে ডাকলো।দেখলাম, পাগলটার দুই হাত ভর্তি আঙটি। প্রতিটা আঙুলেই কম করে হলেও দুটি করে হবে। এতে আর অস্বাভাবিক কী? রাস্তাঘাটে এরকম অনেক আঙটি পড়া পাগলই দেখা যায়। ওর ডান হাতটার দিকে ইঙ্গিত করলো সজিব।
প্রথম দৃষ্টিতেই শরীরটা ঝাড়া দিয়ে উঠলো আমার। ভয়ঙ্কর এক দৃশ্য – টাইগার পাগলার ডান হাতের সবচেয়ে শক্তিশালী আঙ্গুলের সামনের দিকটা মুলোর মতো ফুলে আছে। মোটেও বাহুল্য বলছি না। সত্যি সত্যিই ছোটখাটো একটা মূলোর মতো হয়ে আছে আঙ্গুলটা।কেন, কিভাবে?দেখলাম এই আঙুলে আঁটসাট করে একটি আঙটি পড়া। আর যে অংশটা জুড়ে আঙটি জড়ানো আছে, সেটার আকৃতি স্বাভাবিক। কিন্তু বাইরের অংশটা মুলোর মতো। ধারণা করলাম, হয়তো আঙটিটা নিয়ে সে বিপাকে আছে।কিন্তু এই ধারণাকে পাল্টে দিলেন স্থানীয় এক দোকানী- পাগলারে বইলা কোনো লাভ নাই। লাখ টাকা দিলেও হ্যায় আঙটি খুলবো না।তারপর হাতে করে একটি টর্চ নিয়ে দোকান থেকে বের হলেন লোকটা। আলো ফেললেন টাইগার পাগলার আঙুলের দিকে। গা রি রি করে উঠলো আমার। আঙটি আর মুলোর মাঝামাঝি যায়গাটা একেবারে পঁচে গলে মাংস খসে পড়ছে। কিলবিল করছে পোকা!আমি আর তাকাতে পারলাম না। কেবল ভেতর থেকে একবার অনুভব করার চেষ্টা করলাম ওর যন্ত্রণাটুকু। সেটাও করতে পারলাম না।আরো কয়েকজন লোক জমে গেলো পাগলকে ঘীরে। ওদের সবার কাছেই সে পরিচিত।
ওরা অনেকবার চেষ্টা করেছে টাইগার পাগলাকে হাসপাতালে নিয়ে অপারেশন করানোর। কিন্তু সে যেতে রাজি নয়। ওদের ধারণা এই আঙটি নিয়েই পাগলার সমস্ত সাধনা। আঙটিতেই সে জগত দেখে। আঙটিতেই খুঁজে মুক্তি।অদ্ভ’ত দুনিয়া! অদ্ভ’ত পাগলের ভাবনা! এই অদ্ভ’ত টাইগার পাগলাকে একটি টাইগার কিনে দিলো সজিব। একটু হাসি দিয়ে টাইগারের বোতলটি ধরে খেতে শুরু করলো সে।টাইগার পাগল খাচ্ছে। আর তাকে নিয়ে আলোচনা চলছে জটলায়। দোকানি বললেন- পাগলা বহুত বজ্জাত আছে। গোপনে গোপনে টেকা জমায়। কিন্তু খরচ করে না।বিষয়টা সহ্য হয়নি পাগলার। হঠাৎই ভ’তের স্বরে কথা বলে উঠলো সে- মিথ্যা কথা কমু ক্যন, টেহা আমার আছে। কিন্তু সব মাইনষের কাছে। মাইনষে আমার টেহা মাইরা দ্যয়।কথাগুলো বলতে খুব বেগ পোহাতে হলো টাইগার পাগলার। মুখ দিয়ে শব্দ বেরুতে চায় না। ধীরে ধীরে ঠোঁট নেড়ে চিউ চিউ করছিলো। অর্ধেক কথা মুখ দিয়ে, আর বাকি অর্ধেক বললো নাক দিয়ে। শুনতে অনেকটা ভ’তের কণ্ঠের মতো।তারপর আমাদের সাথে আরো সহজ হয়ে এলো সে। কিন্তু হাতের আঙটিগুলো খুলতে বা আঙুল অস্ত্রোপচার করতে কোনোভাবেই রাজি হলো না।টাইগার পাগলাকে রাজি করাতে না পেরে আমরা হাঁটা ধরলাম লঞ্চ ঘাটের দিকে। এলোমেলো ঘুরলাম কিছু সময়। রাত গভীর হয়ে এলো।
সিদ্ধান্ত নিলাম পানসি বা খেয়া নৌকায় চড়ার। কিন্তু এত রাতে নৌকা কোথায় পাওয়া যাবে?লোকজন তথ্য দিলো, সেই বড় স্টেশনের দিকে পেলেও পেতে পারি।আমরা আবার রওয়ানা হলাম বড় স্টেশন অভিমুখে। রাতের খাবারের ব্যপারে রিকশাচালকের সাথে পরামর্শ করলো তুহিন ও রোমন। চালক শাহজাহান ভাই এর হোটেলের সন্ধ্যান দিলো। আমরা সেখানে রিকশা থামিয়ে জেনে নিলাম হোটেলটি খোলা থাকবে রাত আড়াইটা পর্যন্ত। তখন সময় একটার কাছাকাছি।বড় স্টেশন এলাকায় ঠিক ডাকাতিয়ার তীরে নামলাম রিকশা থেকে। দেখলাম সার ধরে নৌকা বাঁধা আছে। কিন্তু কোনোটাতেই মাঝি নেই। মাঝির সন্ধানে তোড়জোর চালালাম সবাই। নদীর ঢালে নেমে ডাকাডাকিও করলেন আহমদ আমিন। মাথা নুইয়ে নৌকার গলুই এর ভেতর মাঝির সন্ধান করলো সাইমুম সাদ। কিছুতেই ফল হলো না। আমরা নদীর তীর ধরেই এগুতে লাগলাম টোডার মাথার দিকে।হাতের ডানে লক্ষ্য করলাম একটি ক্লাবঘরের মতো। ভেতরে আলো জলছে। সামনে সাইনবোর্ড- মাঝি সমবায় সমিতি। মনে জোর পেলাম আমরা। সমিতিঘরের ভেতরে ঢুকলো তুহিন। একটু পর একজনকে সাথে নিয়ে বের হয়ে হলো।
পেছন পেছন আরো দুইতিনজন কৌতুহলী মাঝি।কিছুক্ষণ মুলামুলি চললো। এ ক্ষেত্রে তুহিনের দক্ষ্য ও কৌশলী ভ’মিকা কাজে দিলো। যথেস্ট আন্তরিকতার সাথে আমাদেরকে নিয়ে ডাকাতিয়ায় নৌকা ভাসালেন মাঝি আবদুর রহিম।রাত তখন একটা বেজে পাঁচ মিনিট। ডাকাতিয়ার ¯রাতে খলবল খলবল করে ঘুরপাক খাচ্ছে। হাতে টানা হাল বেয়ে নৌকা ঠিক রাখতে যথেস্ট বেগ পোহাতে হচ্ছে আবদুর রহিম চাচাকে। আমরা ভাসছি রাতের বিপরীতে। গন্তব্য টোডার মাথার দিক দিয়ে ঘুরে নদীর ওপারের কাছাকাছি গিয়ে তারপর আবার চলে আসবো। ওপারটাতে দেখা যাচ্ছে টিমটিমে আলো।আমরা যখন নদীর মাঝামাঝি পৌঁছি, তখনি নৌকাজুড়ে শুরু হলো গানের মাতম। নদী নিয়ে একটি গানে টান দিলো রোমন- ও.. নদীরে……
সাথে সাথেই কোরাস ধরলো সাইমুম সাদ। তারপর আহমদ আমিন, তুহিন, সজিব এবং সর্বশেষ আমি- একটি কথা শোধাই শুধু তোমারে/ বল কোথায় তোমার দেশ/ তোমার নেই কি চলার শেষ…কোরাসটা যখন ঢিলে হয়ে আসছিলো, তখনি হেঁড়ে গলায় অন্য একটি সুরে টান দিলাম আমি- ও..রে নীল দরিয়া…আপ্লুত হয়ে কোরাস তুললো সবাই- আমায় দেরে দে ছাড়িয়া/ বন্দী হইয়া মনোয়া পাখি হায়রে/ কান্দে রুইয়া রুইয়া/ কাছের মানুষ দূরে থুইয়া/ মরি আমি ধরফরাইয়া রে/ দারুণ জ্বালা দিবা নিশি/ অন্তরে অন্তরে/ আমার এতো সাধের মনোয়া পাখি হায় রে/ কি জানি কি করে …গানটা পুরোই গাইলাম আমরা। একটু পর পর ভোকাল পাল্টালো ঠিক, কিন্তু তালে তেমন হেরফের হলো না। একজনের গলা নেমে আসছে বুঝতে পারলেই আরেকজন গলা খিঁচে তালটা ধরে রাখলাম। সুর হোক বা না হোক।আমি এমন কোনো লোক দেখিনি যে, এই গানটা শুনে বা গেয়ে আপ্লুত হয়নি। এর কথাগুলো জীবনঘনিষ্ঠ। মানুষের জীবন দরিয়ার মতোই।
আমরা ভাসছি এক অদ্ভ’ত দরিয়ায়। নোঙর করছি ঘাটে ঘাটে। বন্দরে বন্দরে দেখছি নতুন জনপদ। মুখরিত হচ্ছি অগুনতি পাখির কোলাহলে। কিন্তু সাধের মনোয়া পাখিটাকে যেখানে রেখে এসেছি, আমাদের নোঙর আটকে আছে সেখানেই।আবারো বলতে হয়, সেই এক মানুষের ভেতর হাজার নদীর প্রবাহের কথা। এই হাজার নদীগুলোই পরষ্পর বয়ে যায় সমান্তরাল। কোনোটা উত্তাল হয়। কোনোটা শান্ত সুশীতল। কোনো নদীতে বাঁধ দিয়ে মেরে ফেলা হয়। আবার স্মৃতির ধূলোয় ঢাকা পড়ে একেকটা নদী। কেউ মরা নদীটার রেখাও মুছে দিতে চায়। আবার কেউ সেই রেখা ধরেই স্মৃতিকাতর হয় সঙ্গোপনে- আমার একটা নদী ছিলো/ জানলো না তো কেউ/ এইখানে এক নদী ছিলো/ জানলো নাতো কেউ/ নদীর জল ছিলো না…/ ও…ও.. জল ছিলো না কুল ছিলো না/ ছিলো শুধু ঢেউ …./ আমার একটা নদী ছিলো/ জানলো না তো কেউ…পথিক নবীর এই গানটা শেষ হতে না হতেই তুহিন টান দিলো আরো একটি স্মৃতি রোমন্থনের সুর- আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম/আমরা/ আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম/ গ্রামের নওজোয়ান/ হিন্দু মুসলমান/ একসাথে বাউলা গান আর মুর্শিদি গাইতাম/ আমরা/ আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম …আগের দিন বাঘে খেয়েছে। দিন গেলে আর দিন ফিরে আসে না।
সময়টা প্রবাহমান। ঠিক এই ডাকাতিয়ার জলের মতো। টোডার মাথা বরাবর মাঝ নদীতে দুই দিক থেকে ¯্রােত এসে মোটামোটি শান্ত একটি ঘূর্ণি তৈরি হয়েছে। এই ঘূর্ণির মাঝখানে যদি সাইমুম সাদকে নৌকা থেকে ফেলে দেয়া যায়, তবে কম করে হলেও আধা কিলোমিটার দূরে গিয়ে ভাসবে।নিশিদলের আরো পাঁচ সদস্যকে রেখে কেবল সাইমুম সাদকে ফেলে দেয়ার প্রশ্ন এলো কেন?কারণ, সাইমুম সাদই সবার চেয়ে হ্যঙলা। সম্ভবত ওজনেও কম। কাজেই ওকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়া অন্য সবার চেয়ে সহজ। সাইমুম সাদের পর হ্যঙলার দিক থেকে দ্বিতীয় স্থানে আছেন আহমদ আমিন। এরপর আর স্থান নির্ধারণ করছি না। কারণ মাসখানেক ধরে খাওয়া দাওয়ার অনিয়মে আমিও শুকিয়ে গেছি। আমার আগের মাপের প্যন্টগুলো ঢিলা হয়ে এসেছে। যায়গায় বেজায়গায় কোমর থেকে নিচে নেমে যায়।এ নিয়ে তুহিন আর রোমন আমাকে খোঁচা মারতেও ছাড়ে না। কি আর করবো- পড়েছি মোগলের হাতে, খানা খেতে হবে একসাথে।খেয়া নৌকা থেকে নেমেই আমরা খানা খাওয়ার জন্য তোড়জোর শুরু করলাম। রাত তখন পৌনে দুইটা। চলে গেলাম সেই শাহজাহান ভাই এর হোটেলে। তারপর শুরু হলো রান্না।
সে আরেক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। হোটেলে ঢোকার প্রথম থেকে শুরু করে শেষ পর্যন্ত খাওয়া নিয়ে রোমাঞ্চিত ছিলাম নিশিদলের প্রতিটা সদস্য। চাঁদপুরের তাজা ইলিশ কেটে ছয়টি টুকরো করা হলো। কড়াইয়ে ঢালা হলো সরিষার তেল। চুলোর আঁচে তেল গরম হয়ে এলে মসলা মাখানো ইলিশটুকরাগুলো ছ্যঁৎ করে ছেড়ে দেয়া হলো কড়াইয়ে। সাথে পেঁয়াজ কুচি আর শুকনা মরিচ।ঘ্রাণেই অর্ধভোজন হয়ে গেলো আমাদের। তারপরও পুরোপুরি ভোজের জন্য জিহ্বা লালায়িত হয়ে রইলো। প্রতিটি সেকেন্ডকে মনে হলো একেকটি ঘন্টা।অবশেষে ইলিশভাজা সমাপ্ত হলো। তার আগেই ছয়জনের সামনে ছয়টি থালা এবং বোলভর্তি গরম ভাত চলে এসেছে। হাত ধুয়ে থালা মেলে বসে আছি সবাই। শাহজাহান ভাই ইলিশভাজাগুলো বড় আকারের একটি গোল বাটিতে করে তুহিনের হাতে ধরিয়ে দিলেন। তুহিন গরম গরম মাছ বন্টন করে দিলো থালায় থালায়। সাথে বন্টন করলো ভাজা পেঁয়াজকুচিও। বলতে দ্বিধা নেই, বন্টন শেষে যে অতিরিক্ত পেঁয়াজকুচি ছিলো, আমি সেগুলোর বেশিরভাগ অংশ নিজ দায়িত্বে আমার থালায় তুলে নিয়েছি।ধারণা করেছিলাম এ নিয়ে দলের অন্যরা আপত্তি তুলবে।
কিন্তু সবাইকে দেখলাম তাজা ইলিশ এবং এর স্বাদের তারিফ করতেই ব্যস্ত। মুখ ভরে তারিফ করার মতোই ছিলো আমাদের এই ভোজটা। কড়া ভাজা টুকরোগুলোর ভেতরে আবার ডিমও রয়েছে। এই ডিমগুলো জিহ্বায় আলাদা মাত্রা যোগ করলো। মোটামোটি সবাই গো গ্রাসে খেয়ে পেট টইটম্বুর করলাম। তারপর থালা চেটেপুটেও খেলাম।অবাক ব্যপার হলো লেখাটা লিখতে গিয়ে বার বার আমি বহুল প্রচলিত শব্দ ‘প্লেট’ এর পরিবর্তে ‘থালা’ শব্দটি ব্যবহার করছি!এর মানে এটা কি ইংরেজি শব্দ নিয়ে সাবরিনার খবরদারির ফল?হলেও হতে পারে। আর হলেই বা ক্ষতি কী? যেখানে ‘থালা’ ব্যবহার করেই সাবলিল বাক্য গঠন করা যায়, সেখানে খামোখা একটি ইংরেজি শব্দকে ডেকে আনার কী প্রয়োজন?তবে অনেক সময় অনেক কিছুকে ডেকে আনতে না চাইলেও চলে আসে। আবার কোনো কোনো সময় সেই চলে আসাটাই খাপ খেয়ে যায়।যেমন আমাদের পরিবেশের সাথে খাপ খেয়েছিলো বৃষ্টিটা। ইলিশভাজার ঢেকুর তুলতে তুলতে আমরা আবার গিয়েছিলাম টোডার মাথায়। ঘড়ির কাটা তখন তিনটা ছুঁই ছুঁই।ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টিটা শুরু হয়েছিলো দুইটা পঁচিশের দিকে। মিনিট সাতেক পর সেটা ঝড়তে শুরু করলো মুষলধারে। টিকলো পঁচ-ছয় মিনিট। তারপর বিরতি।এই বিরতির সময়টাতেই আমরা স্থানান্তরিত হই টোডার মাথায়। উদ্দেশ্য, ভরপেটে অলস সময় কাটানো।
তাছাড়া সেই রণাঙ্গন ছেড়ে আসার অতৃপ্তিটাতো থেকেই গেছে।এবার আগের সেই প্রতিপক্ষ ছায়াদলের অস্তিত্ব পেলাম না সেখানে। কিন্তু আমাদের প্রতিপক্ষ হয়ে আবার ঝড়তে শুরু করলো ইলশেগুঁড়ি। ঠান্ডা ঠান্ডা পরিবেশে বৃষ্টিটা উপভোগ্য, কিন্তু আমাদের মাথার ওপর কোনো ছাদ নেই।সুতরাং আবার রণেভঙ্গ দিয়ে ছাড়তে হবে রণাঙ্গন!না। এবার আর নিশিদলকে পিছু হটতে হলো না। পাশেই পেয়ে গেলাম চটপটি ফোঁচকা বিক্রি করার একটি টঙ দোকান। টঙের ওপরে ছাউনি। আর নিচের দিকে কোমর পর্যন্ত উঁচু করে ইউ আকৃতির ডেস্ক। ইউ এর খোলা মুখ দিয়ে আমরা ঢুকে গেলাম ভেতরে। মাখখানে বড়জোর একজন দাঁড়ানোর যায়গা। গাদাগাদি করেও ছয়জনের সঙ্কুলান হওয়ার কথা নয়।ছাউনির ভেতর প্রবেশ করেই আহমদ আমিনকে দেখলাম পেছনের হাত দিয়ে ভর দিয়ে ডেস্কের ওপর বসে যেতে। তারপর সেখানে পা ঝুলিয়ে আরাম করে বসলো তুহিন এবং রোমন। তিনজন ভালো ভালো তিনটি জায়গা দখল করে বসেছে।বাকি থাকলাম আরো তিনজন। আমি আস্তে করে আহমদ আমিন এবং রোমনকে ঠেলে ঠুলে মাঝখানে যায়গা করে নিলাম। তারপর এলো সজিব।
সে আমার এবং আহমদ আমিনের মাঝখানে বসে একটু চাড়া দিয়ে নিজের আসন পোক্ত করে নিলো। সবশেষে সাদ রোমনকে অনুেরাধ করে এক কোনায় বসার অনুমতি পেল।মোটামোটি সবার নিরাপদ আসন নিশ্চিত হওয়ার পর আকাশে শুরু হলো গুড়–ম গুড়–ম। আমাদেরকেই ধমকাচ্ছে। আমরা পড়োয়া করলাম না। আলাপ শুরু হলো চাঁদপুর, চাঁদপুরের মানুষ ও সংস্কৃতি নিয়ে। তারপর সেই আলাপ গোটা বাংলাদেশের সংস্কৃতিকে উদ্ধার করে ছাড়লো।অন্যদিকে আকাশের গুড় গুড় গুড়–ম ধমকানি চলছেই। দূরে কোথাও বজ্রপাতও হচ্ছে। বইছে ঠান্ডা বাতাস। নদীতে মাঝে মাঝেই দেখা যাচ্ছে লঞ্চের আনাগোনা। লঞ্চবাতির আলোয় স্পস্ট হয়ে উঠছে ¯্রােতস্বিনী ডাকাতিয়া। মাঝ নদীতে উদভ্রান্তের মতো ভেসে চলছে কচুরিপানা। হঠাৎ হঠাৎ আমাদেরকে চমকে দিয়ে পেছন থেকেও উদয় হচ্ছে লঞ্চবাতি। নিরবচ্ছিন্ন অন্ধকারের ভেতর এই আলোর বিভ্রম মোটেও স্বস্তিদায়ক নয়। আর স্বস্তিদায়ক নয় নিজেদের মধ্যে যায়গা দখল নিয়ে প্রতিযোগিতা।তবুও মোটামোটি স্বস্তিতে কাটালাম আধঘন্টার মতো সময়। রাত তিনটা বেজে তেইশ মিনিটে ঝড়তে শুরু করলো মুষলধারে বৃষ্টি।
মিচকে ছাঁট এসে ভিজিয়ে দিতে লাগলো আমাদের। শুরু হলো বৃষ্টির সাথে লুকোচুরি খেলা। এই খেলাটা চললো সাড়ে চারটা পর্যন্ত।পুরো সময়টার প্রথম দিকে বিষয়টাকে পাত্তা দিতে চাইলাম না আমরা। সময়ের সাথে সাথে এর মাত্রা বাড়ছে। সাথে সাথে বাড়ছে কৌনিক বাতাস। বাতাস যতটা কৌনিক হয়ে আসছে বৃষ্টির ছাঁটও আমাদেরকে ততটা পেয়ে বসছে। শরীরজুড়ে বয়ে যাচ্ছে ঠান্ডা শিহরণ। গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গেছে। সবারই ত্রাহি অবস্থা। কিন্তু তুহিনের এতে কিছু আসে যায় না। সে প্রায় নিরুপদ্রব একটি কোনায় বসেছে। তাছাড়া আহমদ আমিনের ব্যগে থাকা লুঙ্গিটা গায়ে জড়িয়ে বেশ আরামও নিচ্ছে।ওর এমন বেপরোয়া আরাম দেখে উদ্যোগটা নিলাম আমি। ডেস্ক থেকে নেমে ইউ আকৃতির ইউ এর মাঝখানে পায়ের স্যন্ডেলগুলো বিছালাম। তারপর পা দুটিকে সামনের দিকে ভাঁজ করে বসে গেলাম স্যন্ডেলের ওপর। এবার আমি পুরোপুরি নিরাপদ। বাইরে থেকে কেউ দেখলে বুঝতেই পারবে না, এখানে কেউ বসে আছে। একটু পর আমার পাশে নেমে আসতে চাইলো সজিবও। আমি একটু চেপে-চুপে তার প্রতি অনুগ্রহ করলাম। একজনের যায়গায় দু’জন বসেছি। এখানে আর কারো স্থান সঙ্কুলান হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। সুতরাং অন্যদের হিংসার পাত্র হয়ে উঠলাম দু’জন।নিশিদলের মাথার ওপর টিনের ছাউনিতে বৃষ্টিপতনের ঝমঝম। আকাশে মেঘের গর্জন। নদীতে উথাল-পাথাল। বাইরে তুমুল বাতাস। বাতাস ও বৃষ্টির ছাঁটের সাথে যুদ্ধ করছে চারজন। আর মাঝখানে উষ্ণ এক আরামকুঠুরিতে বসে রইলাম আমরা দু’জন।তারপর কী হলো?তারপর একসময় বৃষ্টি টুটলো। রাত গড়িয়ে সকাল হলো। আমরা ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। এবং ঢাকায় ফিরেও এলাম সকাল সাড়ে সাতটার লঞ্চ সোনার তরীতে করে।কিন্তু ওসব বর্ণনা করতে গিয়ে আরামকুঠুরির আরামটা মাটি করতে চাই না।