মহামান্য রাষ্ট্রপতি এবং চ্যান্সেলর এডভোকেট আব্দুল হামিদের নির্দেশে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহে (বাকৃবি) জনবলসহ ‘হাওর ও চর উন্নয়ন ইনস্টিটিউট’ নামে নতুন একটি প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি)।
‘হাওর ও চর উন্নয়ন ইনস্টিটিউট’ প্রতিষ্ঠার ফলে হাওর ও চরাঞ্চলের সমস্যা আর অমিত সম্ভাবণা নিয়ে কাজের সুযোগ সৃষ্টি হবে । হাওর ও চরাঞ্চলে সরকারের উন্নয়ন পরিকল্পণা, ভাবনাসমূহ বাস্তবসস্মত-সুলভে এবং টেকসইভাবে বাস্তবায়ন সম্ভব হবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞগণ । এতে হাওর ও চরাঞ্চলের মানুষের জীবন যাত্রার মান উন্নয়ন ঘটবে, আশা করি ।
কৃষি প্রকৌশলী এবং হাওর ভূমিপুত্র হিসাবে খ্যাত ড নিয়াজ পাশা ২০১৩ সালে বাকৃবিতে ‘হাওর কৃষি বিভাগ’ প্রতিষ্ঠার জন্য মহামান্য রাষ্ট্রপতি এবং বিশ্ব বিদ্যালয় সমূহের চ্যান্সেলর এডভোকেট আব্দুল হামিদের কাছে আবেদন করেন। মহামান্য রাষ্ট্রপতি আবেদনটি নির্দেশণা দিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হয়ে ইউজিসিতে পাঠান। আবেদনটি মিডিয়ায় প্রকাশ হলে বিশেষজ্ঞগণ ‘হাওর কৃষি গবেষণা এবং উন্নয়ন ইনস্টিটিউট’ নামকরণের পরামর্শ দেন ।
ভাটির মানুষ পূর্ব পাকিস্তানের গভর্ণর মোনায়েম খান আর প্রথম ভিসি ড ওসমান গনির প্রচেষ্টায় ময়মনসিংহে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল । ‘হাওর ও চর উন্নয়ন ইনস্টিটিউট’ প্রতিষ্ঠায় এ রকম একটি দুর্লভ মুহূর্তের সম্মিলন ঘটেছিল । বাকৃবি’র চ্যান্সেলর এবং রাষ্ট্রপতি হচ্ছেন ভাটির মাটির খাটি সন্তান আব্দুল হামিদ আর ভিসি হচ্ছেন ভাটির আলো বাতাসে বেড়ে উঠা মানুষ প্রফেসর ড মো রফিকুল হক । ভিসি একটি কমিটির মাধ্যমে ‘হাওর কৃষি গবেষণা এবং উন্নয়ন ইনস্টিটিউট’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান সিন্ডিকেটের মাধ্যমে অনুমদন নিতে সক্ষম হন । কিন্ত আমাদের দুর্ভাগ্য, ইউজিসি ভিসি প্রফেসর ড মো রফিকুল হকের পদ ত্যাগের পর ইনস্টিটিউটটি স্থগিত করেন ।
এদিকে ইউজিসি ড নিয়াজ পাশার আবেদন্টির যথার্থতা মূল্যায়ণ পূর্বক রিপোর্ট প্রদাণের জন্য ইউজিসি’র সদস্য এবং বাকৃবি’র সাবেক ভিসি প্রফেসর ড আখতার হোসেনকে আহবায়ক করে এবং বাকৃবি’র সাবেক ভিসি প্রফেসর ড সাত্তার মন্ডল, শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি প্রফেসর ড শাহি আলম এবং বাকৃবি শিক্ষক সমিতির সভাপতি প্রফেসর ড ফজলুল আউয়াল মোল্লা এবং ইউজিসির দুজন সদস্যকে নিয়ে একটি কমিটি গঠণ করেন । তখন রাজনৈতিক অস্থিরতার কারনে কমিটি কয়েকবার উদ্যোগ নিয়েও বাকৃবিতে যেতে পারে নাই । ড নিয়াজ পাশা গত দুই বছর যাবত ইউজিসি, বাকৃবি, কমিটির সদস্যবৃন্দ এবং ডিন কাউন্সিলের সাথে নিয়মিত নিবিড় যোগাযোগ রেখে তাগাদা দিচ্ছিলেন । ক’দিন আগে কমিটি্র ‘হাওর ও চর উন্নয়ন ইনস্টিটিউট’ প্রতিষ্ঠার সুপারিশের প্রেক্ষিতে ইউজিসি তা অনুমোদন দেন ।
এখন সবার আগে প্রয়োজন ‘হাওর ও চর উন্নয়ন ইনস্টিটিউট’ এর অবকাঠামো তৈরী, জনবল নিয়োগ এবং বাজেট সহ কর্ম পরিকল্পণা প্রনয়ণ করে কাজ শুরু করা । মহামান্য রাষ্ট্রপতি এবং চ্যান্সেলর আব্দুল হামিদ যখন কনভোকেশন উপলক্ষ্যে বাকৃবিতে যাবেন, তখন ‘হাওর ও চর উন্নয়ন ইনস্টিটিউট’ ভবনের অবকাঠামো উদ্ধোধনের জন্য প্রস্তত করে রাখা ।
‘হাওর ও চর উন্নয়ন ইনস্টিটিউট’ প্রতিষ্ঠায় মহামান্য রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ এর প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন হাওর ভূমিপুত্র ড নিয়াজ পাশা । তিনি সংসদ সদস্য রেজওয়ান আহমেদ তৌফিক, সাবেক ভিসি ড রফিকুল হক, প্রফেসর ড আলতাফ স্যার, প্রফেসর ড সুলতান উদ্দিন ভূঞা, সাবেক রেজিস্ট্রার আব্দুল খালেক, প্রফেসর ড হাম্মাদুর রহমান, প্রফেসর ড বাহাদুর মিঞা, অধ্যক্ষ বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হক, উপজেলা চেয়ারম্যান চৌধুরী কামরুল আহসান, আব্দুল আজিজ, কৃষিবিদ দীন মোহাম্মদ দীনু এবং কমিটির সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন ।
হাওরের প্রকৃতি, পরিবেশ ও কৃষি দেশের অন্য এলাকা হতে সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং বছরে সাধারণত একটি ফসল উত্পাদন হয়। মূলত হাওরবাসি কৃষি চাষ ও মত্স্য ধরে জীবিকা নির্বাহ করে। এগুলো নিয়ে অদ্যাবধি তেমন কোন গবেষণা হয়নি। প্রতিষ্ঠিত হয়নি কোন কৃষি বা মত্স্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান। হাওরের অফুরন্ত সম্ভাবনা এখনো অব্যবহূত রয়েছে বলে ওখানে কাজ করার সুযোগ অনেক বেশি। ‘সমস্যা যত বড়, সমাধানের পথও তত প্রশস্ত। হাওরের কৃষিকে সাজাতে হবে নতুন আঙ্গিকে, নতুন পরিকল্পনায়, নতুনভাবে।
শুধু ধান চাষ নির্ভরতা কমিয়ে এনে কৃষি বহুমুখীকরণ, যান্ত্রিকীকরণ, সমন্বিত কৃষি, ফসলের নিবিড়তা বাড়ালে মানুষের আয় বাড়বে, দেশ সমৃদ্ধ হবে এবং মানুষ পাবে অধিক পুষ্টি।’ ব্যাপক গবেষণার মাধ্যমেই বর্ষায় হাওরে সবজি/ফসল ও মত্স্য চাষের পদ্ধতি উদ্ভাবনে সফলতা আসতে পারে। আল্লাহর নিয়ামত হাওরের মিঠা পানিকে আমরা কোন কাজে লাগাতে পারিনি। শুধু ‘ধরিব মাছ, খাইব সুখে’ নীতির ফলে হাওর মত্স্য সম্পদ শূন্য হতে চলেছে। কৃষি বিন্যাস, ফার্মিং সিস্টেম, সমন্বিত বালাই দমন ও শস্য ব্যবস্থাপনা প্রবর্তন করে সারা বছরব্যাপী সক্ষম স্বাচ্ছন্দ্যময় কর্মক্ষেত্র তৈরি সম্ভব। হাওরে ধান রোপণ ও কর্তনের জন্য সহজে চলা ও চালনা উপযোগী যন্ত্র উদ্ভাবন করতে গবেষণা করতে হবে। ‘ডুবা সড়ক’ নতুন যুগের সূচনা করেছে। একে সর্বত্র বিস্তার ঘটাতে হবে।
বিদ্যুৎ বা বিকল্প জ্বালানির ব্যবস্থাও থাকতে হবে। উপকূল বা পাহাড়ের উপর যত নজর ও গুরুত্ব দেয়া হয়েছে, হাওর তত উপেক্ষিত রয়েছে। অনাবৃত রয়েছে এর ধন, ধান, মাছ, গো-সম্পদের শ্বেত বিপ্লব ঘটানো, রূপালী সম্পদের ঝিলিক, সোনায় ভরা, সোনার খনি হাওর। আমাদের দুর্দিনে, জনসংখ্যা বিস্ফোরণে আগামী দিনের খাদ্য ভান্ডার, নিশ্চয়তা ও নিরাপত্তার উত্স ভূমিতে রূপান্তর করা সম্ভব আমাদের হাওরাঞ্চলকে। হাওরের জল, জলাশয় ও ভূমির ব্যবহার সম্ভাব্যতা, উত্পাদনশীলতার অংশবিশেষ মাত্র আমরা কাজে লাগাতে পেরেছি। এ জন্যে হাওর উপযোগী উন্নত জাত, প্রায়োগিক প্রযুক্তি ও পদ্ধতি উদ্ভাবনে নিরবছিন্ন গবেষণা দরকার। হাওরাঞ্চলের জীববৈচিত্র্য, মিঠাপানি দেশের সম্পদ, খোদার নিয়ামত। প্রতিষ্ঠিত ‘হাওর ও চর উন্নয়ন ইনস্টিটিউট এবং প্রস্তাবিত মাত্স্য গবেষণা ইনস্টিটিউট স্থাপন বা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে হাওর নিয়ে অধ্যয়ন/ গবেষণার সুযোগ, এ নিয়ামতের সদ্ব্যবহার বাড়িয়ে দেবে।
দেশের খাদ্য নিরাপত্তার স্বার্থেই জরুরিভাবে তা এখনই আরম্ভ করা দরকার। এ বিনিয়োগে রিটার্ন হবে বহুমুখী। সস্তা ও উর্বর জমির জন্য এক সময়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত হতে লোকজন হাওরে এসে বসতি স্থাপন করেছিল। কিন্তু বিভিন্ন কারণে এখন সেখানে উল্টো স্রোত বইছে। হাওরে কৃষি গবেষণার সাফল্যের কারণে ভিটা-বাড়ি ছেড়ে অভিবাসন/ শহরমুখী হাওরের ছিন্নমূল সোনার মানুষদের স্রোত রুখে দেয়া সম্ভব হবে। হাওরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নদী, নালা, খাল, বিল, পুকুরগুলো খনন করে দিলে হাওরের ৮০% সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। প্রতিষ্ঠিত ইনস্টিটিউটে হাওর এবং চরের কৃষি, মত্স্য, পশু সম্পদ, বন, পরিবেশ, মার্কেটিং, গ্রাম্য আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার উন্নয়ন ইত্যাদি বিষয়াদি অন্তর্ভুক্ত থাকবে, আশা করি । দেশে কৃষি শিক্ষা, গবেষণা, সমপ্রসারণ ও উদ্বুদ্ধকরণে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার যে শুভযাত্রার সূচনা হয়েছিল, ‘হাওর ও চর উন্নয়ন ইনস্টিটিউট’ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তা পূর্ণতা পাবে বলে আমার দৃঢ়বিশ্বাস।