জামায়াতের নেতাদের নেপথ্যে রেখে নতুন বিশ্ববিদ্যালয় খোলার অনুমোদন নিয়েছেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য দুর্গাদাস ভট্টাচার্য।বর্তমান সরকারের সময় যে আটটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দেওয়া হয়, তার একটি পেয়েছেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের এই সাবেক উপাচার্য। কিশোরগঞ্জে ঈশা খাঁ ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি নামে অনুমোদন পাওয়া এই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষা কার্যক্রম এখনো শুরু হয়নি। এরই মধ্যে বিভিন্ন অনিয়মে জড়িয়ে পড়েছেন দুর্গাদাসসহ বিশ্ববিদ্যালয়টির একাধিক উদ্যোক্তা।

কিশোরগঞ্জে বিশ্ববিদ্যালয়টির অবস্থান হলেও এর হিসাব খোলা হয়েছে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের চট্টগ্রামের একটি শাখায়। ওই হিসাবে দেড় কোটি টাকার সংরক্ষিত তহবিল স্থায়ী আমানত (এফডিআর) হিসেবে রাখা হয়েছে। কিন্তু এই এফডিআরে বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ারম্যান ও কোষাধ্যক্ষের সই নেই। তাঁদের পরিবর্তে সারোয়ার জাহান ও মোছাদ্দেক ভূঁইয়া সই করেছেন। আবার সারোয়ার ও মোছাদ্দেক এই তহবিলের বিপরীতে এক কোটি ২০ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছেন।
মোছাদ্দেক কিশোরগঞ্জ জেলা জামায়াতের সাবেক আমির, বর্তমানে জামায়াতের জেলা কমিটির শিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক এবং উয়ালি নেওয়াজ খান কলেজের অধ্যাপক।

আর সারোয়ার জাহান চট্টগ্রামে অবস্থিত সাউদার্ন ইউনিভার্সিটির প্রতিষ্ঠাতা এবং বর্তমান কোষাধ্যক্ষ। তিনি ঈশা খাঁ বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি হলেও হিসাব পরিচালনার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত নন। তাঁর বিরুদ্ধে সাউদার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অবৈধ শাখা খোলার অভিযোগ ছিল। পরে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের চাপে শাখা বন্ধ করেন। সারোয়ার জামায়াতের সমর্থক হলেও কোনো কমিটিতে নেই।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুযায়ী, সংরক্ষিত তহবিলের বিপরীতে ঋণ নেওয়া যায় না। কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় এটা করায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সতর্ক করেছে। অভিযুক্ত ব্যক্তিরা ঋণ ফেরতও দিয়েছেন। হিসাবটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে হলেও ওই দুই ব্যক্তির সইয়ে ঋণ দেওয়ার কথা স্বীকার করেন ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক চট্টগ্রামের প্রবর্তন মোড় শাখার ব্যবস্থাপক ফরহাদ আহমেদ। দেড় কোটি টাকার স্থায়ী আমানত খোলার দিনই ২০১১ সালের ১ জুন ওই ঋণ নেওয়া হয় বলে জানা যায়। মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে মোছাদ্দেক ভূঁইয়া ঋণ নেওয়ার বিষয়ে কোনো কথা বলতে চাননি।

সংরক্ষিত তহবিলের বিপরীতে দুই উদ্যোক্তা ঋণ নেওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য উদ্যোক্তাদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে। নেপথ্য উদ্যোক্তা জৈয়ন উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঋণ নেওয়ার বিষয়টি দুর্ভাগ্যজনক। এতে করে আমাদের উৎসাহ-উদ্দীপনা অনেকটাই কমে গেছে।’ তাঁর অভিযোগ, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিলের টাকা কার কাছে কীভাবে আছে, তা উদ্যোক্তা ও অংশীদারদের অনেকেরই জানা নেই।’

তবে সংরক্ষিত তহবিলের বিপরীতে ঋণ নেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান দুর্গাদাস ভট্টাচার্য। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাবের বিপরীতে ব্যাংক যদি কাউকে ঋণ দিয়ে থাকে, তার দায়দায়িত্ব ব্যাংকের।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মোছাদ্দেক বিশ্ববিদ্যালয়ের কেউ নন।

মোছাদ্দেকের বাড়িতেই বিশ্ববিদ্যালয়: জামায়াতের নেতা মোছাদ্দেক কেউ নন—দুর্গাদাস ভট্টাচার্য এ কথা বললেও ঈশা খাঁ ইউনিভার্সিটির বর্তমান ক্যাম্পাস মোছাদ্দেকের বাড়িতেই গড়ে উঠেছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য দুই হাজার ৫০০ বর্গফুট অবকাঠামো প্রয়োজন। ঈশা খাঁ বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য কিশোরগঞ্জ শহরের নীলগঞ্জ সড়কে কাছাকাছি দুটি বাড়ি ভাড়া নেওয়া হয়েছে মাসিক এক লাখ ২০ হাজার টাকায়। এর একটি মোছাদ্দেক আলীর নিজের বাড়ি। তিনি বাড়িটি স্ত্রী জেবুন্নেসার নামে দেখিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে মাসিক ৬০ হাজার টাকায় ভাড়ার চুক্তি করেছেন।

অংশীদারি কেনাবেচা: ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের অংশীদারি’ দেওয়ার কথা বলে উদ্যোক্তারা বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ সংগ্রহ করছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনের ৪১ ধারায় বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থায়নের খাত হিসেবে কোনো জনকল্যাণকামী ব্যক্তি, গোষ্ঠী, দাতব্য ট্রাস্ট বা প্রতিষ্ঠান ও সরকার থেকে নিঃশর্তভাবে দান বা ঋণ; বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব আয় এবং সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের অনুমোদিত অর্থের কথা উল্লেখ আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অংশীদারি দেওয়ার বিনিময়ে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থ নেওয়ার বিধান আইনে নেই।

কিশোরগঞ্জ বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক মুনির উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘মোছাদ্দেক ভূঁইয়া আমার শিক্ষক। বিশ্ববিদ্যালয়ের অংশীদার করার কথা বলায় আমি সাত লাখ টাকা দিয়েছি। কী হবে বা কী হচ্ছে, তা আমি বলতে পারছি না।’ কিশোরগঞ্জ পৌর মহিলা কলেজের শিক্ষক আজিজুল হক বলেন, ‘মোছাদ্দেক ভূঁইয়া আমার কাছে ২০ লাখ টাকা চেয়েছিলেন। জোগাড় করতে পারিনি বলে দেওয়া হয়নি। জোগাড় করতে পারলে দেব।’

এ প্রসঙ্গে দুর্গাদাস বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা বলে কেউ যদি অবৈধভাবে কারও কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে থাকে এবং এমন প্রমাণ পাওয়া যায়, তাহলে তাঁর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

ব্যক্তির নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের জমি: বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের জন্য জমি কেনা হয়েছে ব্যক্তির নামে। ঈশা খাঁ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী ক্যাম্পাসের জন্য ইতিমধ্যে শহরের কিশোরগঞ্জ-হোসেনপুর সড়কের নতুন জেলখানাসংলগ্ন এলাকায় এক কোটি ৭০ লাখ টাকায় ১১৮ শতাংশ জমি কেনা হয়েছে। জামায়াতের নেতা মোছাদ্দেক ভূঁইয়া, তাঁর স্ত্রী জেবুন্নেসা, মেয়ে মরিয়ম জামিলা, ছেলে মুকিম বিন মোছাদ্দেক ও জামাতা মো. হারুন-অর-রশীদ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোক্তা সারোয়ার জাহান, তাঁর স্ত্রী এবং জৈয়ন উদ্দিন, তাঁর স্ত্রীসহ ২০ জনের নামে এই জমি কেনা হয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা জামায়াতের সদস্য জৈয়ন উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদনের আগেই ওই জমি কেনা হয়েছিল। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে দলিল করে দেওয়া হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে সমস্যা হতে পারে ভেবে তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে জড়িত থাকলেও ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য হননি।

তবে দুর্গাদাস ভট্টাচার্য বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে কোনো জমি কেনা হয়নি। কাজেই বিশ্ববিদ্যালয়ের জমি ব্যক্তির নামে কেনার প্রশ্নই আসে না। অংশীদারির কথা বলে বিভিন্নজনের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহের বিষয়ে তিনি বলেন, এমন কোনো ঘটনার সঙ্গে তিনি জড়িত নন।অভিযোগের বিষয়ে জানতে সারোয়ার জাহানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তাঁর মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া যায়।

আরও অভিযোগ: মোছাদ্দেক ভূঁইয়া ও সারোয়ার জাহান ২০০৫ সালের শুরুতে রংপুর শহরের আর কে মিশন সড়কের একটি বাড়ি ভাড়া নিয়ে সাউদার্ন ইউনিভার্সিটির শাখা খোলেন। রংপুরের সচেতন নাগরিকদের হস্তক্ষেপে সাউদার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই অবৈধ ক্যাম্পাস তাঁরা বন্ধ করতে বাধ্য হন। এ ছাড়া মোছাদ্দেক ভূঁইয়া ও জৈয়ন উদ্দিন এর আগে কিশোরগঞ্জ প্রাইম ইউনিভার্সিটির অবৈধ ক্যাম্পাসের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। পরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় কিশোরগঞ্জের সচেতন নাগরিকদের আন্দোলনের মুখে প্রাইম বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই ক্যাম্পাস বন্ধ হয়ে যায়। সাবেক শিক্ষামন্ত্রী এম ওসমান ফারুক নিজের জেলায় অবৈধ শাখা থাকায় সমালোচনার মুখে পড়েন। পরে তিনি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে স্থানীয় প্রশাসনকে নির্দেশ দেন।

বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন পাস হয়। ওই আইনের আওতায় অনুমোদন পেতে ৯৩টি বিশ্ববিদ্যালয় আবেদন করে। এগুলোর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন সরেজমিনে তদন্ত করে ২২টি বিশ্ববিদ্যালয়কে অনুমোদন দেওয়া যেতে পারে বলে মত দেয়। ২২টির মধ্যে ঈশা খাঁ ইউনিভার্সিটির নাম ছিল না।

সুত্রঃ প্রথমআলো