ক্ষেতে ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকার আক্রমণ, ফল পচারোগ, কীটপতঙ্গের আক্রমণ, সার-বীজ-কীটনাশক ব্যবস্থাপনাসহ নানা প্রতিকূলতায় গরিবের সবজিবা বেগুন চাষ করতে কৃষকের দম যায় যায় অবস্থা। তাদের এ দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি দিতে নতুন জাতের বেগুন উদ্ভাবন করেছেন ময়মনসিংহের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক এবং আইপিএম ল্যাবের প্রধান গবেষক অধ্যাপক ড. মো. বাহাদুর মিঞা। তাঁকে সহায়তা করেছেন দুজন পিএইচডি ও ২৩ এমএস ডিগ্রিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থী।

গবেষকরা জানান, ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকার আক্রমণে বেগুনের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়।

 কৃষককে অর্থনৈতিক ক্ষতি থেকে রক্ষা করতেই তাঁরা এ গবেষণা শুরু করেন। দেশের প্রধান ২২টি বেগুন চাষ এলাকা পরিদর্শন শেষে এ নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। বেগুনের বিভিন্ন ধরনের রোগ শনাক্ত এবং তা ঠেকানো যায়_এমন একটি নতুন জাতের বেগুনের বীজ উদ্ভাবনের জন্য সাত বছর গবেষণা চালানো। তারই সফল প্রচেষ্টা বাউ বেগুন-১বাউ বেগুন-১-এর বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বলতে গিয়ে উদ্ভাবক ড. বাহাদুর মিঞা বলেন, ‘জাতীয় বীজ বোর্ডের নিবন্ধিত ও নতুন বেগুনের জাতটি একই সঙ্গে ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকা এবং ফল পচা প্রতিরোধী।

 গাছ মধ্যম আকৃতির, উচ্চতা ৪০ থেকে ৯৪ সেন্টিমিটার, গড়ে ৬৪ দশমিক ৭ সেন্টিমিটার, গাছপ্রতি পাতার সংখ্যা গড়ে ১৫০টি, গাছপ্রতি ফলের সংখ্যা গড়ে ১০টি, প্রতিটি ফলের ওজন ২৫০ থেকে ৩৫০ গ্রাম, ফলপ্রতি বীজের ওজন ১২ থেকে ২০ গ্রাম, চারা লাগান থেকে ফুল ধরা পর্যন্ত সময় লাগে ৭৪ দিন। যার চাষ অর্থনৈতিকভাবে অনেক বেশি লাভবানের সুযোগ সৃষ্টি করবে। তাঁর মতে, অধিকাংশ বেগুনক্ষেতে সমস্যা হচ্ছে ফল ও ডগা ছিদ্রকারী পোকার আক্রমণ এবং এর ফলে গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত ও বেগুনের বাজারজাতকরণের মান হ্রাস। কিন্তু বাউ বেগুন-১ জাতটি চাষে কৃষককে কীটনাশক ব্যবহার করতে হবে না। ফলে মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকিও থাকবে না। বেগুনটির জাত ও চাষ মাঠপর্যায়ে সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি সাহায্য প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন।

বাউ বেগুন-১চাষপদ্ধতি

 চাষ উপযোগী মাটি ও চাষাবাদের সময়

সব ধরনের মাটিতেই এ জাতের বেগুনের চাষ করা যায়। তবে বেলে-দোআঁশ মাটি সবচেয়ে উপযোগী। মধ্য সেপ্টেম্বর থেকে মধ্য অক্টোবরে বীজতলায় বীজ বপন এবং মধ্য অক্টোবর থেকে মধ্য নভেম্বর চারা লাগানোর উপযুক্ত সময়।

জমি প্রস্তুত

তিন-চারটি চাষ ও মই দিয়ে জমি তৈরি করতে হবে। শেষ চাষের সময় নির্ধারিত পরিমাণ গোবর সার ও টিএসপি ছিটিয়ে দিয়ে পুনরায় চাষ ও মই দিতে হবে।

সারের পরিমাণ ও প্রয়োগ
সার হেক্টরপ্রতি (কেজি)
গোবর ১০০০০
খৈল ৫০০
ইউরিয়া ১৪০
টিএসপি ১২০
এমওপি ১০০
বায়োপেস্টিসাইড (ট্রাইকোডারমা) ৬৪
জমি তৈরির সময় গোবর, খৈল, টিএসপি সার এবং নির্ধারিত পরিমাণের অর্ধেক এমওপি সার জমিতে মিশিয়ে দিতে হবে।
 চারা লাগানোর সাত দিন আগে জমিতে বায়োপেস্টিসাইড (ট্রাইকোডারমা) প্রয়োগ করতে হবে।
 ইউরিয়া ও পটাশ সমান তিন ভাগে ভাগ করে চারা লাগানোর ১৫, ৩০ ও ৪৫ দিন পর পর প্রয়োগ করতে হবে।

বীজ শোধন

বপনের আগে বীজগুলো সবজি বীজ শোধনযন্ত্রের সাহায্যে শোধন করতে হবে। এ জন্য প্রথমে বীজ ব্যাগের মধ্যে ভরে ১০ থেকে ১৫ মিনিট ৫৩-৫৫০ সেন্টিমিটার তাপমাত্রায় শোধন করতে হবে। এরপর বীজগুলো ছায়ার মধ্যে শুকিয়ে নিতে হবে।

বীজ বপনপদ্ধতি

বীজতলায় এ জাতের বীজ বপনের নিয়ম বেগুনের অন্যান্য জাতের মতোই। তবে অনেক ক্ষেত্রে বেগুনের বীজ বপন করার পর পিঁপড়ায় বীজ নিয়ে যায়। ফলে অঙ্কুরোদগম কম হয়। তাই সতর্কতাস্বরূপ বীজতলায় সেভিন ডাস্ট বা গুঁড়োজাতীয় কীটনাশক ছিটিয়ে দিলে ঝুঁকি থাকবে না।

রোপণপদ্ধতি ও চারার সংখ্যা

জমি চাষ সম্পন্ন হলে ভূমি থেকে ১০ থেকে ১৫ সেন্টিমিটার উঁচু বেড তৈরি করতে হয় এবং বেডের চারপাশে ড্রেনের ব্যবস্থা রাখতে হয়। এ বেডে চার সপ্তাহ বয়সের চারা লাগানো হয়। চারা লাগানোর সঙ্গে সঙ্গে চারায় পানি দিতে হয়। সারি থেকে সারি ও গাছ থেকে গাছের দূরত্ব ৭৫ সেন্টিমিটার। চারা লাগানো ও লালনপদ্ধতি প্রচলিত অন্যান্য জাতের লালনপদ্ধতির অনুরূপ। প্রতি হেক্টরে ১৭ হাজার ৮০০টি (১৭ হাজার ৮০০)।

পরিচর্যা

প্রয়োজনবোধে জমির অবস্থা বুঝে হালকাভাবে গাছে সেচ দিতে হবে। চারা লাগানোর পর জমিতে আগাছা দেখা দিলে নিড়ানি দিয়ে জমির মাটি ঝুরঝুরে করে দিতে হবে এবং হালকাভাবে আগাছা পরিষ্কার করে ফেলতে হবে।

রোগ ও পোকামাকড় দমন

এ জাতটি অনুমোদিত হওয়ার আগে সাত বছর ধরে বিভিন্ন এলাকায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছে। এ দীর্ঘ সময় কোনো ক্ষতিকারক পোকামাকড় দেখা যায়নি। তবে কোনো কোনো ক্ষেতে গোড়া পচারোগ দেখা যায়। সে ক্ষেত্রে জমিতে বায়োপেস্টিসাইড প্রয়োগ করলে এ রোগের প্রকোপ কমে যায়।

বীজ সংগ্রহ এবং সংরক্ষণ

পাকা ফল সংগ্রহের পর ঘরে তিন-চার দিন রাখতে হবে, যাতে ফলগুলো নরম হয়। এর ফলে বীজ সংগ্রহ করতে সুবিধা হবে। ফলগুলো নরম হলে দুই ভাগে কেটে বীজগুলো একটি কাচের অথবা প্লাস্টিক পাত্রে সংগ্রহ করতে হবে। এরপর বীজগুলো পরিষ্কার পানি দিয়ে ভালো করে ধুয়ে মশারি নেটের সাহায্যে সংগ্রহ করতে হবে। সংগৃহীত বীজগুলো ভালো করে রোদে শুকিয়ে কাচ বা প্লাস্টিক পাত্রে মুখ ভালোভাবে বন্ধ করে সংরক্ষণ করতে হবে।

ফল সংগ্রহ

বেগুন খাওয়ার উপযোগী হলে তা তুলে নিতে হবে। গবেষণায় দেখা গেছে, এ জাতের বেগুনের হেক্টরপ্রতি ফলন ৪০ টন।

নিয়ামুল কবীর সজল ও তাওহিদুল ইসলাম, ( ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়)