বলা যায়, তিনি আসলে নামে মাত্র অন্ধ।  নাম তাঁর ওসমান প্রামাণিক।ওসমান পারেন না এমন কাজ নেই। ইট ভাঙা, চাটাই বোনা, খড় কাটা, বাঁশের ডালা তৈরি, মাটির ভাড় তৈরি, গরু-ছাগলের জন্য খাবার বানানো ও খাওয়ানো থেকে শুরু করে গাছেও চড়েন। খেজুর গাছের ডাল কেটে গাছের কাণ্ড ছেঁচে লাগিয়ে দেন রসের হাড়ি। পাশাপাশি বিক্রি করেন আইসক্রিম। একটুও অসুবিধে হয় না টাকা গুনতে।

ওসমান বললেন, সাধনা আর চেষ্টা থাকলে চোখ থাকতে হয় না। চোখ তাদের বেশি দরকার, যাদের সাহসের অভাব।ওসমানের বয়স তখন সবে ১০। পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র। হঠাৎ আক্রান্ত হলেন টাইফয়েডে। সেরে ওঠেন ঠিকই কিন্তু চোখজোড়া তাঁর নষ্ট হয়ে যায়। প্রথম দিকে দিনের বেলায় ভালো দেখলেও রাতে একদমই দেখতেন না। দিন দিন অবস্থা আরো খারাপের দিকে যায়। ৩৮ বছর আগে ঘটে আরেক দুর্ঘটনা। খেজুর গাছে হাঁড়ি লাগাতে গিয়ে পড়ে যান। আঘাত পেয়ে সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যায় দুই চোখ। ডাক্তার দেখিয়েও লাভ হয়নি।

ওসমানের ব্যবহৃত প্রতিটি যন্ত্রপাতিই ধারালো। তবু দুর্ঘটনার নজির নেই। শীতের মৌসুম নিজের গ্রামসহ আশপাশের আরো কয়েকটি গ্রামে খেজুর গাছে রসের হাঁড়ি লাগিয়ে দেন ওসমান। সেই রস বিক্রির টাকায় উঠে আসে সংসারের খরচের অনেকটা। এ ছাড়া ডালি তৈরি ও সেলাই করতেও সূঁচ ব্যবহার করেন পটু হাতে।

ওসমান বলেন, আগে যখন চোখ ভালো ছিল, তখন তিনি এসব কাজই করতেন। কিন্তু চোখ নষ্ট হওয়ার পর দীর্ঘদিন এসব করতে পারেননি। এদিকে পরিবারে উপার্জন করার কেউ নেই। তাই বাধ্য হয়ে শেখা শুরু করলেন নানান কাজ। প্রথম প্রথম কষ্ট হতো। একসময় সয়ে আসে। প্রতিটি কাজের আগে মনে মনে একটি পরিকল্পনা করে নেন। কোথায় কী থাকবে, কতটুকু এগোলে কোনটা হাতে পাবেন, কীভাবে ধরবেন এইসব। তারপর সেই অনুযায়ী এগোতে থাকে কাজ। পরিবারের মানুষরা প্রথম প্রথম ভয় পেতেন। কখন কী হয়। কিন্তু এখন আর তাঁর অন্ধত্ব নিয়ে কেউই চিন্তিত নয়।

ওসমানের বয়স এখন ৭০-এর কাছাকাছি। দুই ভাই আর এক বোনের মধ্যে ওসমান বরাবরই সাহসী। তাই হাল ছাড়েননি এ বয়সেও। চোখে না দেখেই ১২ সদস্যের পরিবার চালাচ্ছেন। এতটুকু অভাব বুঝতে দেননি কাউকে। বিয়ে করেছেন ৫২ বছর আগে। ১০ ছেলেমেয়ের জনক। অন্ধ স্বামীর প্রতি স্ত্রী রহিমা বিবির ভালবাসার কমতি ছিল না। মাস চারেক আগে মারা যান তিনি। গ্রামের স্থানীয় পৌর কাউন্সিলর ওসমানকে বয়স্ক ভাতার ব্যবস্থা করেন। তাতে এক মেয়ের পড়াশোনার খরচ চালাচ্ছেন তিনি

বাস মালশন গ্রামে হলেও কাজকর্মের জন্য আশপাশের অন্য গ্রামের সবাই তাঁকে একনামে চেনে। তাঁর এ বিরল ক্ষমতা নিয়ে মোটেও গর্ব করেন না। জীবনের শেষ দিকে এসে তাঁর কাজের পরিধি কমিয়ে ফেলেছেন অনেক। তবে কেউ যদি দেখতে চায়, হাসিমুখেই হয়তো তরতর করে উঠে যাবেন খেজুর গাছে কিংবা বুনতে বসবেন বাঁশের ডালা।

– কালের কন্ঠ