ঢাকা: সরকারের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে সময়ক্ষেপণ এবং নানা তালবাহানা চলছে। উন্নয়ন প্রকল্পকে বিঘ্নিত ও বিলম্বিত করতে অপতৎপরতায় লিপ্ত প্রশাসনের একটি চক্র। বিগত জোট সরকারের আমলে যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও দলীয় বিবেচনায় একাধিক পদোন্নতি পাওয়া প্রায় পাঁচ শতাধিক কর্মকর্তা এই চক্রের সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে জড়িত বলে জানা গেছে। এদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে বলে  সরকারের দায়িত্বশীল একটি সূত্র বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম.বিডিকে জানিয়েছেন।

ধীরগতি ও তালবাহানা করে উন্নয়ন প্রকল্পের বাস্তবায়নকে নস্যাৎ করার ষড়যন্ত্র চলছে বলে এরই মধ্যে সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী এমনকি খোদ প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে উষ্মা প্রকাশ করা হয়েছে। এজন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারিও বারবার উচ্চারণ করা হচ্ছে। কিন্তু তাতে খুব একটা ফল মিলছে না।

সম্প্রতি প্রশাসনের কাজকর্মে আরো গতিশীল ও নিষ্ঠাবান হতে কমর্কতা-কর্মচারীদের কঠোর নির্দেশ দিয়ে একটি প্রজ্ঞাপনও জারি করা হয়। সংস্থাপন মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা ওই পরিপত্রে (স্মারক নং ৫.১৫৫.০৩৯.০১.০০.০০২. ২০০৮-১০৯(৫০) বলা হয়, ‘… লক্ষ্য করা যাচ্ছে, সচিবালয় নির্দেশমালায় অনুচ্ছেদগুলোর নির্দেশনা যথাযথভাবে অনুসরণ করা হচ্ছে না। সচিবালয়ের নির্দেশমালার নির্দেশনা পালন করা কর্মকর্তা/কর্মচারীদের জন্য বাধ্যতামূলক’।

পরিপত্রে সচিবালয় নির্দেশমালার ৮৩ অনুচ্ছেদ উল্লেখ করে আরও বলা হয়, ‘সকল শাখায় একটি করিয়া হাজিরা বহি থাকিবে। উপস্থিতির জন্য নির্ধারিত সময়ের ১৫ মিনিট পর শাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ইহাতে স্বাক্ষর করিবেন এবং উপ-সচিবের নিকট অর্ধঘণ্টার মধ্যে পেশ করিবেন। শিথিল সময়ের পর  কোনো কর্মচারী অফিসে আসিলে তাহাকে বিলম্বের জন্য কারণ দর্শাইতে হইবে। অফিসে উপস্থিতির জন্য নির্ধারিত সময়ের পর ১৫ মিনিটের মধ্যে যুগ্ম সচিব ও তদূর্ধ্ব কর্মকর্তার ব্যক্তিগত কর্মচারীরা তাহাদের হাজিরা সংশিষ্ট যুগ্মসচিব অথবা উপসচিব (প্রশাসন)-এর নিকট পাঠাইয়া দিবেন।’ পরিপত্রে সচিবালয় নির্দেশমালার ৮৪ নং অনুচ্ছেদ উল্লেখে করে বলা হয়, ‘মাসে প্রতি তিনদিন বিলম্বে উপস্থিতির দরুন একদিন নৈমিত্তিক ছুটি কাটা যাইবে। অভ্যাসগতভাবে বিলম্বে আগমনকারীদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করিতে হইবে। হাজিরা বহিতে নৈমিত্তিক ছুটির হিসাব রাখিতে হইবে।’

অথচ পরিপত্র জারির পর বরং হিতে বিপরীত হয়েছে। প্রশাসন আগের চেয়ে আরও নাজুক অবস্থায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। এই অভিমত সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার।

প্রশাসনে স্থবিরতা ও ইচ্ছেকৃত ঢিলেমি প্রসঙ্গে প্রশাসনের শীর্ষস্থানীয় অপর এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম.বিডিকে জানান, যোগ্যতা থাকা  সত্ত্বেও সিনিয়র কর্মকর্তাদের পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত করা, এমনকি জুনিয়র ও বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগে অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দিয়ে সিনিয়র কর্মকর্তাদের ওপরে পোস্টিং দেওয়ার কারণেই  প্রশাসনে আজ এই স্থবিরতা।

প্রশাসনকে গতিশীল ও জবাবদিহিমূলক করতে সরকার ‘স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ পদোন্নতি’ নীতিমালা প্রণয়ন করতে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংস্থাপন সচিব ইকবাল মাহমুদ। এজন্য সরকার প্রশাসন সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে। জবাবদিহিমূলক প্রশাসন গড়তে আমরা একটি স্বচ্ছ পদোন্নতি নীতিমালা প্রণয়নের চেষ্টা করছি। এটা প্রণয়ন ও অনুসরণ করা হলে  পদোন্নতি নিয়ে আর কোনো প্রশ্ন ও অভিযোগ উঠবে না।

‘সরকারি কর্মকর্তাদের কাজ জনগণের সেবা করা ’ একথা উলেখ করে সংস্থাপন সচিব আরো বলেন, ওই নীতিমালা অনুযায়ী যিনি ভালো কাজ করবেন, তিনিই দ্রুত পদোন্নতি পাবেন। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করার ১ মাসের মাথায়ই সিভিল ও পুলিশ প্রশাসনের অসংখ্য সিনিয়র মেধাবী কর্মকর্তাকে চাকরি থেকে অকালীন অবসর দেওয়া শুরু হয়।

২৯ নভেম্বর ২০০১-এ প্রথম চাকরিচ্যুত করা হয় ১১ জনকে। এই প্রক্রিয়া চলতেই থাকে। ১৯৬ কর্মকর্তাকে ২০০৩-এর মধ্যেই অকালীন অবসর দেওয়া হয়। এরা সবাই মুক্তিযোদ্ধা।

এখানেই শেষ নয় নগ্ন দলীয়করণের পথ প্রশস্ত করতে বিদ্যমান পদোন্নতি নীতিমালাটিতে আনা হয় পরিবর্তন। আর এরই সুবাদে জোট সরকারের কট্টর সমর্থক বলে পরিচিত শতাধিক কর্মকর্তাকে যুগ্ম-সচিব, অতিরিক্ত সচিব পদে ঢালাওভাবে পদোন্নতি দেওয়া হয়।

এক পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, জোট সরকার তাদের মেয়াদের প্রথম ১৩ মাসেই উপ-সচিব থেকে সচিব বানিয়েছে শতাধিক কর্মকর্তাকে। যাতে নির্বাচন কমিশন কোনো অবস্থাতেই জোট সরকারের দলীয় আনুগত্যের বাইরে কোনো কর্মকর্তাকে মাঠপর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ বিশেষ করে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় জড়িত পদে পদায়ন করতে না পারে।  সেই লক্ষ্য পূরণে একশ নয়, দুশো নয় বরং ৬ শ’ সিনিয়র সহকারি সচিবকে দলীয় আনুগত্যের ভিত্তিতে উপ-সচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। অথচ পর্যাপ্ত শূন্যপদও ছিল না। এসত্ত্বেও এমন তোঘলকি কাণ্ডই করা হয়েছে।  উদ্দেশ্য ছিল নির্বাচন কমিশনকে পুরোপুরি কুক্ষিগত করা। জোট সরকারের নিয়োজিত জেলা প্রশাসকদের প্রত্যাহার করে নতুন করে জেলা প্রশাসক নিয়োগ দিলেও যাতে জোট সরকারের নিজস্ব দলীয় কর্মকর্তাদের মধ্য থেকেই নিয়োগ দিতে নির্বাচন কমিশন বাধ্য থাকে।

২০০১ সালে জামায়াত-বিএনপির সঙ্গে মতার অংশীদারিত্ব পাওয়ার পরই জনপ্রশাসনে গুরুত্বপূর্ণ এবং স্পর্শকাতর পদগুলোতে নিয়োগ ও পদোন্নতিতে ঘটেছে নগ্ন জামায়াতিকরণ।  কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই প্রশাসনের সর্বক্ষেত্রে লাগামহীন জামায়াতিকরণ করা হয়। পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ২০তম ও ২১তম বিসিএস-এর  বিভিন্ন ক্যাডারে নিয়োগ দেওয়া হয় ২ হাজার ৮৭৩ জন কর্মকর্তা। অথচ চারদলীয় জোট সরকার ২৪, ২৫, ২৬ ও ২৭তম বিসিএস-এর আওতায় নিয়োগ দেয় ১০ হাজার ৭১৫ জন কর্মকর্তা। এদের অধিকাংশই চারদলীয় জোটের অনুগত।

আওয়ামী লীগ আমলে বিসিএস পরীক্ষা নিয়ে কোনো প্রশ্ন ওঠেনি। কিন্তু জোট সরকারের আমলে বিসিএস-এ প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়া ছিল স্বাভাবিক ঘটনা। প্রশ্নপত্র ফাঁস করে চারদলীয় জোটের ক্যাডারদের প্রশাসন ও পুলিশসহ বিভিন্ন সার্ভিসে নিয়োগ দেওয়া হয়। পিএসসিও তখন ছিল জোট সরকারের একটি দলীয় প্রতিষ্ঠানের মতো। চারদলীয় জোট মতায় বসেই ২৩তম বিসিএস বাতিল করে দেয় মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তানদের প্রাধান্য থাকার কারণে।

দায়িত্বশীল সূত্রে জানা যায়, জোট আমলে এসব দলীয় নিয়োগে বেশি লাভবান হয়েছে জামায়াত। জামায়াত প্রশাসনে লোক নিয়োগে তাদের সাংগঠনিক তৎপরতা চালিয়েছে পরিকল্পিতভাবে। জোট আমলে দেশের সব জেলা প্রশাসনসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, দপ্তর-অধিদপ্তরে নিয়োগ দেওয়া হয় ৭০ হাজার লোক। এদের অধিকাংশই চারদলীয় জোটের দলীয় ক্যাডার। ২৬ হাজারের মতো নিয়োগ করা হয় পুলিশ বিভাগে। এদের মধ্যে দলীয় ক্যাডারই বেশি। সন্ত্রাসী দাগি আসামিরাও নিয়োগ পেয়েছে জোট সরকারের বদৌলতে।

জনপ্রশাসনের এই নিদারুণ অবস্থায় ক্ষমতা নেয় মহাজোট সরকার। প্রধানমন্ত্র্রী শেখ হাসিনা নিজেও প্রশাসনকে গতিশীল ও নিরপেক্ষ করার তাগিদ বোধ করেন। বিভিন্ন সময়ে তার দেওয়া বক্তব্যই তার প্রমাণ। প্রশাসনে গতিশীলতা আনতে সরকার তাই উদ্যোগী হয় । এজন্য কিছু  নতুন নিয়মনীতিও প্রবর্তন করা হয়। সচিবদের সঙ্গে একাধিক বৈঠকে ও প্রধানমন্ত্রী প্রশাসনকে গতিশীল করতে আহ্বান জানিয়েছেন।

গত ১৮ অক্টোবর সচিবদের সঙ্গে সর্বশেষ বৈঠকে প্রশাসনে কাজের গতির মন্থরতা নিয়ে, বিশেষ করে বার্ষিক  উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে মন্থর গতির উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী  তার অসন্তোষ প্রকাশ করেন।  সরকাররে নয় মাসে এডিপি বাস্তবায়ন হার ছিল ৬৩ শতাংশ। সচিবদের কাজে অসন্তোষ প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাফ বলে দেন, ‘কে কতটুকু দায়িত্ব পালন করেন তা আমি দেখেছি। দায়িত্ব ঠিকমতো পালন না করলে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে। কেউ এমন ভাববেন না যে, আমি সরকারের খুব কাছের লোক। আমি যা ইচ্ছা তা-ই করতে পারব। যারা এ রকম ভাবছেন তারা বোকার র্স্বগে বাস করছনে। আমার দরকার নিষ্ঠা, সততা ও র্কমদক্ষতা। কাজের ফল না পেলে তিনি যত মহাশক্তিধরই হোন, আমাদের প্রশাসনে তার স্থান নেই।’

সম্প্রতি জাতীয় সংসদের উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীও বলেছেন,  ‘জোট সরকারের সুবিধাভোগী আমলারা সরকারের উন্নয়ন কর্মকান্ডকে ব্যাহত করতে চায়। যারা এর সাথে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ’

শিগগিরই উন্নয়নমূলক কাজকে বাধাগ্রস্ত করার সঙ্গে জড়িতদের, বিশেষ করে প্রশাসনের শীর্ষ  পর্যায়ে থেকে যারা সরকারকে পেছনে ঠেলে দেওয়ার অপচেষ্টা চালাচ্ছেন তাদের চিহ্নিত করা ও ব্যবস্থা নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হতে যাচ্ছে। এমনকি স্থানীয় কর্মকর্তা যারা সরকারের কাজে অসহযোগিতা করছেন তারাও রেহাই পাবেন না। সরকারের শীর্ষমহল থেকে এমন আভাসই পাওয়া গেছে।

উল্লেখ্য বর্তমান মহাজোট সরকারের আমলে গত ৭ সেপ্টেম্বর তিন স্তরে ৪৯৪ র্কমর্কতার পদোন্নতি দেওয়া হয়। এর মধ্যে অতরিক্তি সচিব পদে ৬০ জন, যুগ্মসচিব পদে ১৬৩ জন এবং উপসচিব পদে ২৭১ জন।