রেলওয়ে ‘লাইনচ্যুত’

৪০ বছরে জনসংখ্যা বেড়ে দ্বিগুণ হলেও রেলওয়ের যাত্রী ও মালামাল পরিবহন কমেছে। এর ফলে রেলওয়ে একটি লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে রেলওয়ে বছরে লোকসান গোনে গড়ে ৫০০ কোটি টাকা। গত নয় বছরে রেলওয়ে লোকসান দিয়েছে তিন হাজার কোটি টাকার বেশি।
রেলওয়ের হিসাব অনুযায়ী, ১৯৬৯-৭০ অর্থবছরে রেলওয়েতে যাত্রী পরিবহন হয়েছিল সাত কোটি ২৮ লাখ জন এবং মালামাল পরিবহন হয়েছিল প্রায় ৪৯ লাখ মেট্রিক টন। কিন্তু জনসংখ্যা দ্বিগুণ হলেও ২০০৮-০৯ অর্থবছরে রেলওয়ে যাত্রী পরিবহন করে সাড়ে ছয় কোটি জন এবং মালামাল পরিবহন করে ৩০ লাখ টন।
১৯৭৪ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী দেশের জনসংখ্যা ছিল সাত কোটি ৬৪ লাখ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী ২০০৮ সালে দেশের জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১৪ কোটি ৬০ লাখে।
সরকারের স্থল পরিবহন নীতি অনুযায়ী ২০১২ সালের মধ্যে নারায়ণগঞ্জ থেকে জয়দেবপুর পর্যন্ত প্রতিদিন ট্রেনে দুই লাখ যাত্রী পরিবহনের কথা। কিন্তু বর্তমানে রেলওয়ে সারা দেশে গড়ে দৈনিক যাত্রী পরিবহন করছে পৌনে দুই লাখ।
২০০৮ সালে বিশ্বব্যাংকের পরিবহন খাত পর্যালোচনা-বিষয়ক এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, পঁচাত্তরে সারা দেশের মালামালের ২৮ শতাংশ রেলওয়ের মাধ্যমে পরিবহন হয়েছিল। ওই বছর সড়কপথে মালামাল পরিবহন হয় ৩৫ শতাংশ। কিন্তু ২০০৫ সালে এসে রেলপথে মালামাল পরিবহন কমে দাঁড়ায় ২ দশমিক ৯৪ শতাংশে। একই বছর সড়কপথে মালামাল পরিবহন বেড়ে হয় ৬৯ দশমিক ৫৯ শতাংশ।
খাদ্য ও জ্বালানি তেলসহ বিভিন্ন পণ্য সারা দেশে পরিবহনের জন্য রেলওয়ে সত্তরের দশকে গুরুত্বপূর্ণ সব গুদামের সঙ্গে রেল সংযোগ গড়ে তোলে। রেলওয়ের পশ্চিমাঞ্চলে এ ধরনের ৫২টি লাইনে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। ৩৮ লাইনে মাঝেমধ্যে ট্রেন চলে।
দীর্ঘদিন ধরে রেলওয়ে নিয়ে গবেষণা করছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) উপাচার্য এ এম এম সফিউল্লাহ। রেলওয়ের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘রেল লাইনচ্যুত হয়ে গেছে। এটাকে লাইনে আনতে হবে। এ জন্য বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।’ তিনি বলেন, বিশ্বের সব দেশই রেলওয়েকে জনপ্রিয় করতে বিনিয়োগ করছে। আর বাংলাদেশে সড়কপথকে অতিমাত্রায় গুরুত্ব দিয়ে রেলকে দেউলিয়া করে ফেলা হয়েছে।
বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক আলমগীর মুজিবুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ১৯৬০ সালে সড়ক, রেল ও নৌপথ মিলিয়ে যত যাত্রী পরিবহন হতো, তার ৭৪ শতাংশই রেলের ছিল। কিন্তু এখন তা ৬-৭ শতাংশের বেশি নয়। এর জন্য সরকারের অবহেলা, জনবলের অদক্ষতা ও উন্নয়ন-সহযোগীদের অসহযোগিতা দায়ী বলে মনে করেন তিনি।
লোকসান বাড়ছে: ১৯৬৯-৭০ সালে রেলওয়ে যাত্রী ও মালামাল পরিবহন বাবদ পাঁচ কোটি টাকা আয় করেছিল। সর্বশেষ ২০০৮-০৯ অর্থবছরে রেলওয়ে লোকসান গোনে ৫৪৭ কোটি ৪০ লাখ টাকা। রেলওয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০০০-০১ থেকে ২০০৮-০৯ অর্থবছর পর্যন্ত নয় বছরে রেলওয়ে তিন হাজার ৩৬ কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে। তবে রেলওয়ের কর্মকর্তারা জানান, এই লোকসানের মধ্যে রেলওয়ে স্কুল ও হাসপাতাল পরিচালনাসহ কল্যাণমূলক কাজে ব্যয় করা অর্থও রয়েছে।
রেলওয়ের কর্মকর্তারা জানান, ১৯৬৯-৭০ সালে রেলওয়েতে জনবল ছিল প্রায় ৫৬ হাজার। বর্তমানে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৩০ হাজারে। এ জন্য প্রায় দেড় শ স্টেশন বন্ধ হয়ে গেছে। চালকের সংকটের কারণে অনভিজ্ঞদের দিয়ে ট্রেন চালাতে হচ্ছে। এতে ট্রেনের সময়সূচি ঠিক রাখা যাচ্ছে না।
যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন রেলওয়ের দুরবস্থার কথা স্বীকার করে প্রথম আলোকে বলেন, রেলওয়ের সমস্যাটি আগে কোনো সরকার বুঝতে পারেনি। এখন সমস্যা চিহ্নিত করা গেছে। এক বছরের মধ্যে ইতিবাচক অগ্রগতি হবে বলে জানান তিনি।
রেল এগোচ্ছে না: স্বাধীনতার পর যমুনা সেতু থেকে বগুড়ার জামতৈল পর্যন্ত ৯৩ কিলোমিটার নতুন রেললাইন স্থাপন করা হয়েছে। এর বিপরীতে বন্ধ হয়েছে প্রায় পৌনে ৩০০ কিলোমিটার রেলপথ।
জানা গেছে, রেলওয়ের মালামাল ও যাত্রীর একটা বড় অংশই চট্টগ্রামকেন্দ্রিক। কিন্তু এই পথে একটি মাত্র রেললাইন। ফলে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে একটি ট্রেন চালাতে হলে অন্য ট্রেনকে পথে কোনো স্টেশনে দাঁড় করিয়ে রাখতে হয়। টঙ্গী-ভৈরব বাজার ৬৪ কিলোমিটার পথে আরেকটি রেললাইন নির্মাণে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের সহায়তায় প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু গত দুই বছরে এই লাইন নির্মাণে ঠিকাদার নিয়োগ দিতে পারেনি কর্তৃপক্ষ।
ইঞ্জিন-সংকট: বর্তমানে রেলওয়েতে ইঞ্জিন রয়েছে ২৮৬টি। অধিকাংশ ইঞ্জিনের বয়স ৩১ থেকে ৪১ বছর। ২০ বছরের নিচে ইঞ্জিন আছে মাত্র ৬৩টি। সব ইঞ্জিনের মধ্যে ৪০টি স্থায়ীভাবে অকেজো।
চলাচলের উপযোগী ২৪৬টি ইঞ্জিনের মধ্যে গড়ে অন্তত ৭৫টি মেরামতের জন্য কারখানায় থাকে। অর্থাৎ সব সময় ব্যবহারের জন্য পাওয়া যায় গড়ে ১৭০টি। এর মধ্যে অন্তত ৩০-৩৫টি ইঞ্জিন ব্যবহার হয় দুর্ঘটনাকবলিত ট্রেন উদ্ধার ও উন্নয়নকাজে। সারা দেশে আন্তনগর, মেইল, লোকাল ও মালগাড়ি মিলে দৈনিক ট্রেন চলে প্রায় ৩১০টি।