ডিম ছাড়ার জন্য সমুদ্র ছেড়ে উজান বেয়ে নদীতে আসে যেসব মাছ, সেগুলোর অন্যতম হলো ইলিশ। পদ্মার ইলিশ এতটাই সুস্বাদু যে দেশের বাইরেও এর খ্যাতি আছে। কিন্তু সুস্বাদু এ ইলিশ এবার ছেড়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের জলসীমা। তাদের নতুন উৎস ভারতের নর্মদা ও তপতী নদী। ফলে জেলেরা এখন তাঁদের জালে আর আগের মতো ইলিশ পাচ্ছেন না। আগের কয়েক বছরের ঘাটতির পর এবার বাজারে প্রচুর ইলিশ চোখে পড়ছে। এগুলোর বেশির ভাগ সাগরের। তবে এ অবস্থাও কত দিন থাকবে, তা নিয়ে সন্দিহান গবেষকরা।

বাংলাদেশ  মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের জ্যেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আনিসুর রহমানের মতে, বিজ্ঞানের ভাষায় ইলিশ এক ধরনের অ্যানাড্রোমাস মাছ। জীবনের অধিকাংশ সময় তারা সমুদ্রে কাটায়। তবে ডিম ছাড়ার মৌসুমে উজান ঠেলে নদীতে চলে আসে, যেখানে তাদের মায়েরা ডিম ছেড়েছিল। এগুলোর মধ্যে কিছু মাছ আবার বেশি উজানে দূরবর্তী নদীতেও চলে আসে। এসব ইলিশই সবচেয়ে সুস্বাদু।

২০ বছরের বেশি সময় ধরে ইলিশের গতিধারার ওপর গবেষণা করছেন আনিসুর রহমান। ডাউন টু আর্থ নামের একটি ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে আনিসুর রহমানের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়, ‘প্রথম দিকে ইলিশ ডিম ছাড়ার জন্য বঙ্গোপসাগর থেকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পদ্মা ও মেঘনায় প্রবেশ করত। পশ্চিম ধরে গঙ্গার দিকেও এগোতো। তবে বাংলাদেশের নদীগুলোতেই এগুলোর ছিল অবাধ বিচরণ। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশের জলসীমায় এগুলোর বিচরণ কমে যাচ্ছে এবং ভারতীয় জলসীমার দিকে এগুলোর যাতায়াত বেড়ে যাচ্ছে। ডাউন টু আর্থ ওয়েবসাইটের প্রতিবেদনটির এক গ্রাফে দেখা যায়, বাংলাদেশের ইলিশ একসময় ফারাক্কা হয়ে চলে যেত উত্তর প্রদেশ পর্যন্ত। ফারাক্কা বাঁধের কারণে সে পথ এখন অনেকটা রুদ্ধ।

এখন ভারত মহাসাগর থেকে ইলিশ যাচ্ছে গুজরাটের নর্মদা ও তপতী নদীতে। সে ইলিশ আসছে কলকাতার বাজারে।নদীতে এখন আর ইলিশের তেমন একটা দেখা পাওয়া যায় না। ফলে ইলিশ পেতে এখন জেলেদের গভীর সাগরে যেতে হয়।’ এর কারণ ব্যাখ্যা করে আনিসুর রহমান বলেন, গত ১০ বছরে বাংলাদেশের সীমার কাছে সাগরে ডুবোচরের সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। কিন্তু ইলিশ মুক্ত পানি পছন্দ করে। ফলে এগুলো বাংলাদেশের পানি ছেড়ে চলে যাচ্ছে।

বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটে আনিসুর রহমানের সহকর্মী জি সি হালদার ইলিশের বড় আবাস পদ্মার পানি শুকিয়ে যাওয়াকে এ মাছের পরিমাণ কমে যাওয়ার একটি বড় কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন। তিনি জানান, ১৯৭৫ সালে শুকনো মৌসুমে (এপ্রিল_জুলাই) পদ্মায় পানিপ্রবাহ ছিল ৬৫ হাজার থেকে ৭০ হাজার কিউসেক। ফারাক্কা বাঁধের কারণে নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে এ প্রবাহ ৩০ হাজার কিউসেকে নেমে আসে। আর এটি নদীতে ইলিশ কমে যাওয়ার একটি বড় কারণ।

ভারতীয় বিজ্ঞানীদের মধ্যেও কেউ কেউ ফারাক্কা বাঁধের ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করেন না। তাঁদেরই একজন পরিমল রায়। ভারতের গঙ্গায় অধিক ইলিশ রয়েছে_আনিসুর রহমানের এমন বক্তব্য তিনি সমর্থন করেন না। কেননা তিনি মনে করেন, ওই বাঁধ ইলিশের স্থান পরিবর্তনের ক্ষমতাকে সীমিত করে ফেলেছে। তাঁর মতে, বাঁধের মধ্য দিয়ে স্থানান্তরের জন্য ইলিশের যাতায়াতের একটি পথ রাখা যেত। কিন্তু পরিমল রায়ের মতে, বাঁধ এলাকাটি এখন নির্বিচারে মাছ শিকারের কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয়েছে। ‘ইকোলজিক্যাল ইমব্যালেন্স অব দ্য গঙ্গা রিভার : ইটস ইমপ্যাক্ট অন এগ্রিকালচার’ বইয়ে তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘ফারাক্কা নির্মাণের আগে কখনো এ অবস্থা ছিল না। এখন অনেক সময় বাঁধের কাছে সহস্রাধিক মাছ ধরার নৌকা একসঙ্গে দেখা যায়।’ তিনি জানান, বাঁধটি নির্মাণের আগে মাছ নদী সাঁতরে উত্তর প্রদেশের এলাহাবাদ পর্যন্ত চলে যেত। কিন্তু বাঁধটি এখন মাছের স্থান পরিবর্তনে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বাংলাদেশের অভ্যন্তরে চট্টগ্রামের হালদা ও সিলেট জেলার নদীগুলোর দূষণকে ইলিশের সংখ্যা হ্রাস পাওয়ার আরেকটি বড় কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন জি সি হালদার। আনিসুর রহমান এ প্রসঙ্গে বলেন, শুধু ইলিশ নয়, দূষণের কারণে নদীগুলোতে অন্যান্য মাছও কমে যাচ্ছে। একসময় চট্টগ্রামের নদীগুলোতে ৭০টির বেশি প্রজাতির মাছ ছিল। আর দূষণের ফলে কমতে কমতে এখন সেখানে ১০টি প্রজাতিও খুঁজে পাওয়া ভার।

সরকার নভেম্বর থেকে মার্চের মধ্যবর্তী সময়ে জাটকা (পোনা ইলিশ) ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। আনিসুর রহমান এ বিষয়ে বলেন, ‘২০০২ সালে আমরা সিদ্ধান্তে আসি, জেলেরা যদি জাটকা শিকার বন্ধ করে, তবে বাংলাদেশে ইলিশের উৎপাদন ৩০ হাজার টনের মতো বাড়ানো সম্ভব।’ তবে এ সিদ্ধান্তের জন্য তিনি নিজেদের কৃতিত্বকে বড় করে দেখার পক্ষপাতী নন। তাঁর মতে, মাত্রাতিরিক্ত মাছ শিকার রোধে প্রচলিত ধর্মীয় সংস্কার থেকেই জাটকা নিধন রোধের এ ধারণা নেওয়া হয়। তিনি ব্যাখ্যা করেন, বাঙালিদের জন্য ইলিশ ধরার মৌসুম হলো মার্চ থেকে অক্টোবর।

আগে কখনো লক্ষ্মীপূজা (অক্টোবরের মাঝামাঝি থেকে শেষ) আর সরস্বতী পূজার (ফেব্রুয়ারির শুরু থেকে মাঝামাঝি) মধ্যবর্তী সময়ে ইলিশ খাওয়া হতো না। হিসাব করলে দেখা যাবে, এ দুই পূজার মধ্যবর্তী সময়টি (যে সময়ে ইলিশ শিকারের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে) হলো জাটকার বেড়ে ওঠার মৌসুম। সহজেই অনুমেয়, ইলিশের বেড়ে ওঠা ও উৎপাদন নিশ্চিত করতেই ধর্মীয় এ চর্চার সূত্রপাত হয়েছিল। আনিসুর রহমান জানান, হিন্দু সম্প্রদায়ের পাশাপাশি অনেক মুসলমানও এটি মেনে চলত। আর এ প্রথা থেকেই বিজ্ঞানীরা জাটকা নিধন রোধে আইন করার প্রয়োজনীয়তার ধারণাটি নেন।

বাংলাদেশ মৎস্য অধিদপ্তরের যুগ্ম পরিচালক রতন দত্তের মতে, বাংলাদেশের জেলেরা ওই প্রথা নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়ে পরিত্যাগ করেন। তিনি বলেন, “নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝিতে থাইল্যান্ড থেকে আমাদের দেশে বেশ সূক্ষ্ম এক ধরনের জাল আসে প্রচুর। বিশেষভাবে তৈরি মিহি বুননের এ জালে খুব সহজেই জাটকা ধরা পড়ত। আর এর ব্যবহারও খুবই সহজ। স্থানীয়ভাবে এ জালের নাম দেওয়া হয়েছিল ‘কারেন্ট জাল’। খুব দ্রুতই ঢাকার আশপাশে এ জাল তৈরির কারখানা বিস্তার লাভ করে।”

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান জানান, ১৯৯৯ সালে এ জালের ব্যবহার নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। কিন্তু ‘প্রভাবশালীদের’ ছত্রচ্ছায়ায় কোনো ধরনের শাস্তির মুখোমুখি না হয়েই কিছু জেলের মধ্যে এ জালের ব্যবহার চলতে থাকে। তবে আনিসুর রহমান জাটকা শিকারে নিষেধাজ্ঞা আরোপে সুফল পাওয়া গেছে উল্লেখ করে জানান, এতে পূর্ণবয়স্ক ইলিশের উৎপাদন প্রায় ছয় হাজার টন বেড়েছে। তবে তিনি এও জানান, জেলেরা এখনো বছরে ১০ থেকে ১৫ হাজার টন জাটকা শিকার করে থাকেন। রাজধানীর কারওয়ান বাজারে বিক্রেতাদের নিয়ে আসা জাটকাভর্তি ঝুড়িগুলোই এর সত্যতা প্রমাণ করে।

সীমান্তের ওপারেও জাটকার ব্যবসা বেশ জমজমাট। পশ্চিমবঙ্গে জাটকাকে ‘খোকা ইলিশ’ নামে ডাকা হয়। ২০০৬ সালে রাজ্য সরকার ৫০০ গ্রামের কম ওজনের ইলিশ শিকারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। পশ্চিমবঙ্গের মৎস্যমন্ত্রী কিরণ্ময় নন্দ জানান, পাইকারি বাজারে নিয়মিত অভিযান চালানো হয়। তবে সংশ্লিষ্ট বিভাগের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানান, সাধারণ মানুষের পূর্ণবয়স্ক ইলিশ কেনার সামর্থ্য নেই। কিন্তু মোটামুটি ২৫০ টাকা কেজিতে খোকা ইলিশ পাওয়া যায়। আর এ সুযোগে অবৈধভাবে ইলিশ শিকার বেড়ে চলেছে। ওই কর্মকর্তা বলেন, ২০০৬ সালে নিয়মিত বিরতিতে বাজারে অভিযান পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কিন্তু এতে কোনো ফল হয়নি।

কলকাতার একটি স্কুলের শিক্ষিকা সর্বাণী বসু খোকা ইলিশ শিকার বা খাওয়াকে তেমন দোষের কিছু মনে করেন না। তাঁর মতে, বড় ইলিশের চেয়ে বরং খোকা ইলিশ অনেক বেশি সুস্বাদু। তবে তাঁর বোন জয়ন্তী অবশ্য ইলিশের মৌসুমে খাবারে বাংলাদেশি ইলিশের অতুলনীয় স্বাদের কথা মনে করে এখনো স্মৃতিকাতর হয়ে ওঠেন।

– কালের কন্ঠ