হাওরাঞ্চলের একমাত্র ফসল বোরো ধান পাহাড়ি ঢল ও অকালবন্যায় তলিয়ে যাওয়ার পর কৃষকেরা আর্থিক অনটন মোকাবিলা করতে ইতিমধ্যে গোয়ালের ৮০ শতাংশ গরু বিক্রি করে দিয়েছেন। এখন পর্যন্ত গোয়ালে যে সামান্যসংখ্যক গরু আছে, তার খাদ্য জোগাড় করতে গিয়ে কৃষকদের আর্থিক অনটন আরও বেড়ে গেছে। বর্তমানে ময়মনসিংহ অঞ্চলের বিভিন্ন উপজেলা থেকে নৌকায় করে নিয়ে আসা খড় হাওরাঞ্চলে প্রতি মণ ৩০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।

কৃষক পরিবারকে রক্ষায় সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসন সম্প্রতি উপজেলা পরিষদকে চিঠি দিয়েছে। চিঠিতে উপজেলা পরিষদের নিজস্ব অর্থায়নে গোখাদ্যের জন্য কৃষকদের সহযোগিতার কথা বলা হলেও টাকা না থাকায় উপজেলা পরিষদ এ ব্যাপারে কোনো সহযোগিতা করতে পারছে না।
সুনামগঞ্জের তাহিরপুর, জামালগঞ্জ উপজেলার হাওরাঞ্চলের গ্রামগুলো ঘুরে এবং কৃষক ও কৃষির সঙ্গে সম্পর্কিত লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বছরের সাত মাস হাওরাঞ্চলের গ্রামগুলো ছাড়া আশপাশের সবই পানিতে নিমজ্জিত থাকে। এ সময় খড় দিয়ে কৃষকেরা গোখাদ্যের চাহিদা মিটিয়ে থাকেন। কিন্তু এ বছর হাওরের ধান তলিয়ে যাওয়ায় গরুর খাদ্যসংকট চরম আকার ধারণ করেছে।

তাহিরপুর উপজেলার দক্ষিণ শ্রীপুর ইউনিয়নের টাংগুয়ার হাওর পারের লামাগাঁও গ্রামের কৃষক ফারুক মিয়া (৫৫)। তিনি এ বছর টাংগুয়ার ও গলগলিয়া হাওরে ৩০ কিয়ার (৩০ শতাংশে এক কিয়ার) জমিতে ধান চাষ করেছিলেন। অকালবন্যায় তাঁর সবটুকু জমির ফসলই পানিতে তলিয়ে যায়। এ জন্য তিনি গোয়ালের আটটি গরুর পাঁচটিই বিক্রি করে দিয়েছেন। অবশিষ্ট তিনটি গরুর জন্য প্রতি সপ্তাহে তাঁকে পাঁচ মণ খড় কিনতে হচ্ছে।

উপজেলার কলমার হাওর পারের কৃষক আলম মিয়া (৩৮) গোয়ালের ১২টি গরুর সাতটি বিক্রি করে দিয়েছেন। তিনি জানান, গরুর খড় কিনতে গিয়ে তিনি আর্থিক অনটনে পড়েছেন। হাওর তলিয়ে যাওয়ার পর গবাদি পশুর খড়সহ নানা ধরনের আর্থিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি পেলেও এখন পর্যন্ত তাঁরা কোনো সহায়তা পাননি।

দক্ষিণ শ্রীপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান হারুনুর রশিদ বলেন, গোখাদ্যসংকট ও পরিবারের অভাব ঘুচাতে কৃষকেরা অধিকাংশ গরুই বিক্রি করে দিয়েছেন। এখন পর্যন্ত সামান্যসংখ্যক যে গরু গোয়ালে আছে, সেগুলোকে ৩০০ টাকা মণ খড় কিনে খাওয়াতে হচ্ছে। এতে কৃষকদের অভাব আরও বেড়ে গেছে।

মাটিয়ান হাওর উন্নয়ন কমিটির সভাপতি আবদুল জলিল তালুকদার বলেন, হাওরের জমি আর গোয়ালের গরুই হাওরাঞ্চলের কৃষকদের বাঁচার অবলম্বন। প্রত্যেক কৃষক আপ্রাণ চেষ্টা করছেন অন্তত দু-চারটি গরু তাঁদের গোয়ালে রাখার। এতে পরিবারগুলোতে আর্থিক অনটন আরও বেড়েছে।

জামালগঞ্জ উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান শামীমা শাহরিয়ার বলেন, সুনামগঞ্জের হাওরাঞ্চলে গোখাদ্য সংকট চরমে। তাহিরপুরের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মুহাম্মদ আনোয়ার হোসেন বলেন, গোখাদ্য সংকট বিষয়ে উপজেলা প্রশাসন অবগত আছে। এ ব্যাপারে আমাদের চেষ্টা রয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত সরকার থেকে কোনো সহায়তা আসেনি।

তাহিরপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আনিসুল হক বলেন, হাওরাঞ্চলের কৃষকদের জন্য এ বছরটি খুবই সংকটের। এ সংকট থেকে কৃষকদের রক্ষার জন্য প্রয়োজন সরকারি সহযোগিতা। জেলা প্রশাসন গোখাদ্যের জন্য পরিষদের অর্থায়নে কৃষকদের সহায়তার কথা বললেও তহবিলে টাকা না থাকায় উপজেলা পরিষদ কৃষকদের কোনো সহযোগিতাই করতে পারছে না।

সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. ফয়জুর রহমান বলেন, ‘জেলা ও উপজেলা পরিষদের মাধ্যমে আমরা এ সংকট কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছি। গোখাদ্য বা এ জাতীয় কোনো সহায়তা এলেই তা দ্রুত কৃষকদের মধ্যে বণ্টন করা হবে।

-প্রথম আলো