কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উপজেলায় গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ কর্মসূচি টেস্ট রিলিফের (টিআর) বিভিন্ন প্রকল্পে মহাজোটের নেতা-কর্মীরা অনিয়ম ও দুর্নীতি করেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। কোথাও কাজ হয়েছে নামে মাত্র। আবার কোথাও কাজ না করেই টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে।

উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার (পিআইও) কার্যালয় থেকে পাওয়া তথ্যমতে, ২০১০-১১ অর্থবছরে তিন দফায় পৌরসভাসহ সারা উপজেলায় ২৫৭ দশমিক ১৮৮ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য ও ৬৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। গত ৩০ জুনের আগে সব প্রকল্পের বরাদ্দ দেওয়া শেষ হয়। কাজের অগ্রগতি প্রতিবেদনে পিআইওর কার্যালয় কোনো কোনো প্রকল্পের ১০০ শতাংশ, কোথাও ৯৯ শতাংশ, ৮৫ শতাংশ, ৮০ শতাংশ অথবা ৫০ শতাংশ দেখিয়েছে। কিন্তু খোঁজখবর নিয়ে এ প্রতিবেদনের সত্যতা মেলেনিসংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, সব বরাদ্দ আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির নেতারা ভাগাভাগি করে নিয়েছেন। পরে দলীয় নেতা-কর্মীরা তাঁদের পছন্দমতো প্রতিষ্ঠানে এসব বরাদ্দ দিয়েছেন।

গত ২২ জুন স্থানীয় সাংসদ (করিমগঞ্জ-তাড়াইল নির্বাচনী এলাকা) মুজিবুল হক উপজেলার বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও মসজিদের নামে ২২টি প্রকল্পে টিআরের ১৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ দিয়ে প্রতিষ্ঠানগুলোর তালিকা প্রকল্প কর্মকর্তার কার্যালয়ে পাঠিয়ে দেন। কিন্তু বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানই বরাদ্দের টাকার কাজ শুরু করেনি। এর প্রায় দেড় মাস আগেও সাংসদ ১৩৯টি প্রকল্পে টিআরের নগদ ৪৭ লাখ টাকা বরাদ্দ দেন। ওই প্রকল্পেও ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

করিমগঞ্জ ডিগ্রি কলেজে সাইকেলস্ট্যান্ড নির্মাণ, আসবাব ক্রয় ও কলেজ মাঠের উন্নয়নের জন্য তিন লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। নিয়ম অনুযায়ী, বরাদ্দের পর সাত দিনের মধ্যে কাজ শেষ করতে হয়, কিন্তু এখন পর্যন্ত এ প্রকল্পের কোনো কাজ করা হয়নি। এর সত্যতা নিশ্চিত করে অধ্যক্ষ মোক্তার হোসেন প্রথম আলোকে জানান, যত দ্রুত সম্ভব তাঁরা কাজ শুরু করবেন। করিমগঞ্জ পাইলট বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের নামে বরাদ্দ হওয়া এক লাখ টাকার কাজও শুরু করেনি কর্তৃপক্ষ।

করিমগঞ্জ-পুলেরঘাট মোহাম্মদীয়া জামে মসজিদ উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয় ৩০ হাজার টাকা। মসজিদের সভাপতি মাহবুবুর রহমান জানান, তাঁরা পেয়েছেন মাত্র পাঁচ হাজার টাকা। জাতীয় পার্টির স্থানীয় এক নেতার নাম উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘বাকি টাকা কোথায় গেছে, ওই নেতাকে জিজ্ঞেস করুন।’মাছিমপুর সরকারি প্রাথমিকবিদ্যালয়ের সভাপতি সোলায়মান ভূঁইয়া বলেন, ‘বিদ্যালয়ের নামে বরাদ্দকৃত ৩০ হাজার টাকার অর্ধেক পেয়েছি। বাকি অর্ধেক নেতারা হাতিয়ে নিয়েছেন।’

উপজেলার জাফরাবাদ ইউনিয়নের কাইকুরদিয়া মাদ্রাসার আসবাব কেনার জন্য ৩০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। মাদ্রাসাসংলগ্ন মসজিদের ইমাম হাবিবুর রহমান জানান, কাজ হওয়া তো দূরে থাক, বরাদ্দের কথা এই প্রথম শুনলেন তিনি। পাঠানপাড়া বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে, তাদের বিদ্যালয়ের নামে বরাদ্দ হওয়া ৩০ হাজার টাকা তারা পায়নি।

গত এপ্রিলে বরাদ্দ হওয়া ১৩৯টি প্রকল্পের ১৮০ টন টিআরের খাদ্যশস্য মহাজোটের নেতা-কর্মী ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা লুটে নিয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে করিমগঞ্জ খাদ্যগুদামের নামে দুই টন, চাতলবাজার উন্নয়নের জন্য তিন টন ও সিংগুয়া মৌলভীবাজার উন্নয়নের চার টন খাদ্যশস্য বরাদ্দ দেওয়া হয়। চাতলবাজারের ব্যবসায়ী আবদুল কাইয়ুম বলেন, বাজারে একটি নলকূপ বসানো ছাড়া কিছুই করা হয়নি। আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির উপজেলা পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

করিমগঞ্জের পিআইও আবদুল ওয়াদুদ ভূঁইয়া গত ২৯ জুন অবসরে গেছেন। তাঁর সময়ে এসব প্রকল্পের বরাদ্দ দেওয়া হয়। টিআরের কাজে দুর্নীতি ও অনিয়ম প্রসঙ্গে তিনি জানান, লোকবলের অভাবে তাঁরা প্রকল্পগুলো যথাযথভাবে তদারক করতে পারেননি। তার পরও কোনো বিষয়ে লিখিত অভিযোগ পেলে বর্তমানে যিনি দায়িত্বে আছেন, তিনি তদন্ত করে দেখবেন।জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা নিত্যানন্দ দাস জানান, টিআরের অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে তাঁর কাছে কোনো লিখিত অভিযোগ আসেনি। অভিযোগ পেলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবেন।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আবদুল্লাহ হাক্কানী জানান, স্থানীয় সাংসদের তালিকা ও প্রকল্প কমিটি অনুযায়ী টিআর বিতরণ করা হয়েছে। টিআর ও কাবিখা পর্যবেক্ষণ কমিটির প্রধান সাংসদ নিজে, তবে দুর্নীতির লিখিত অভিযোগ পেলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সদস্যসচিব আবদুর রহমান জানান, টিআর নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরা যা করেছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।

-প্রথম আলো