ম্যারাডোনা-মেসির মাঠ কাঁপানো আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপ মিশন শুরু করছে আজ। জোহানেসবার্গের এলিস পার্কে ‘বি’ গ্রুপের এই ম্যাচে আর্জেন্টিনার প্রতিপক্ষ আফ্রিকান সুপার ঈগল খ্যাত নাইজেরিয়া। এই ম্যাচের মধ্য দিয়েই যেন শুরু হলো বিশ্বকাপের আসল উত্তাপ। অবশ্য মাঠে নামার আগেই তাপ ছড়িয়েছেন এ সময়ের ফুটবল সেনসেশন লিওনেল মেসি। ‘এই বিশ্বকাপ হবে আমার, এই বিশ্বকাপ হবে আর্জেন্টিনার’_ এমন ঘোষণা দিয়েছেন মেসি। দুই যুগ পর আর্জেন্টিনা যে শিরোপা জিততে মরিয়া, ফিফা ও ইউরোপিয়ান বর্ষসেরা মেসির কথা থেকেই তা পরিষ্কার। প্রথম ম্যাচ নিয়ে নির্ভার ম্যারাডোনাও। তার ভাষায়, ‘ছেলেদের নিয়ে আমি ভীষণ আশাবাদী। তারা যেভাবে খেলছে তাতে এ মুহূর্তে আমি পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ।’ এই ম্যাচের আগেই ম্যারাডোনা বাহিনীকে তাতিয়ে দিয়েছেন ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তি পেলে। আগের দিন পেলে বলেন, ‘এই বিশ্বকাপের ফাইনালে ব্রাজিলের প্রতিপক্ষ হতে পারে একটি আফ্রিকান দল।’ আর তাই আজ প্রথম ম্যাচ থেকেই পেলেকে ভুল প্রমাণ করার চ্যালেঞ্জ ম্যারাডোনা-মেসিদের। অন্যদিকে পেলেকে সত্য প্রমাণ করা এবং একই সঙ্গে নিজের মহাদেশে ভালো করার চ্যালেঞ্জ আফ্রিকান সুপার ঈগলদের।
বিশ্ব ফুটবলে বেশিরভাগ বড় দলকেই গিলতে হয়েছে আফ্রিকান তেতো স্বাদ। ১৯৮২ সালের বিশ্বকাপে আফ্রিকান দল আলজেরিয়ার কাছে হারে জার্মানরা। পরের বিশ্বকাপে দ্বিতীয় রাউন্ডে তাদের প্রতিপক্ষ ছিল মরক্কো। ম্যাচের আগে ওই সময়ের জার্মান কোচ ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার বলেছিলেন, ‘আফ্রিকানরা খুবই বিপজ্জনক।
ওদের মুখোমুখি
যত না হওয়া যায় ততই মঙ্গল।’ ২০০২ সালের বিশ্বকাপে আগেরবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ফ্রান্সকে ১-০ গোলে হারায় সেনেগাল। আফ্রিকার এই ভয়ঙ্কর রূপের সঙ্গে অনেক আগেই পরিচয় হয়ে গেছে ম্যারাডোনার। ১৯৯০ সালের বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচেই আফ্রিকান অদম্য সিংহখ্যাত ক্যামেরুনের
কাছে ০-১ গোলে হারের লজ্জায় ডুবতে হয়েছিল ম্যারাডোনা বাহিনীকে। অবশ্য মুদ্রার আরেকটি পিঠও আছে। আজকের প্রতিদ্বন্দ্বী নাইজেরিয়ার বিপক্ষে কিন্তু আর্জেন্টিনার রেকর্ড ঈর্ষণীয়। মুখোমুখি লড়াইয়ে নাইজেরিয়ার বিপক্ষে চার ম্যাচের তিনটিই জিতেছে তারা। বাকি একটি ম্যাচ শেষ হয় গোলশূন্যভাবে। সর্বশেষ এ দু’দল মুখোমুখি হয়েছিল ২০০৮ সালের বেইজিং অলিম্পিক ফাইনালে। ম্যাচে নাইজেরিয়াকে ১-০ গোলে হারিয়ে শিরোপা জিতে নেন মেসি-কার্লোস-তেভেজরা। এর আগে দু’দল মুখোমুখি হয় ২০০২ সালের বিশ্বকাপে। গ্রুপ পর্বে নাইজেরিয়াকে ১-০ গোলে হারায় দু’দুবারের বিশ্ববিজয়ীরা। ১৯৯৪ সালের বিশ্বকাপে সুপার ঈগলদের ২-১ গোলে হারায় আর্জেন্টিনা। আর তাই গ্রুপিং হওয়ার পর থেকেই আর্জেন্টিনা দুঃস্বপ্ন থেকে তারা বেরিয়ে আসবে_ প্রায় নিয়মিত বিরতিতে এমন প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসছে সুপার ঈগলরা। তাদের কৃতী স্ট্রাইকার নুয়ানকো কানুর ভাষায়, ‘বেশ কিছুদিন ধরেই আমরা আর্জেন্টিনার বিপক্ষে খারাপ ফল করছি। এবার আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। আমার বিশ্বাস, আমি গোল পাব এবং আর্জেন্টিনার বিপক্ষে হাসিমুখেই মাঠ ছাড়তে পারব।’
পেছনে ম্যারাডোনা, সামনে মেসি_ ফুটবলপ্রেমীদের জন্য এর চেয়ে আবেগময় আর কিছু হতে পারে না। কোটি কোটি আর্জেন্টাইন ভক্তের মতো শুরু থেকেই মেসির কাছে অনেক বেশি চাওয়া ম্যারাডোনার। প্রিয় শিষ্যকে নিয়ে উচ্ছ্বসিত ম্যারাডোনা বলেন, ‘মেসি বিশ্বসেরা। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ যে মেসি একজন আর্জেন্টাইন। এ দলটি ১৯৮৬ সালের আমাদের দলের মতোই। আর মেসি ১৯৮৬ সালের আমার চেয়েও ভালো।’ তবে মেসি ছাড়া বাকিদের ওপরও অগাধ আস্থা ম্যারাডোনার। তার ভাষায়, ‘ছেলেরা আর্জেন্টাইন গর্ব ফিরিয়ে আনার জন্য ক্ষুধার্ত।’ মেসি এখনও আর্জেন্টিনার হয়ে উঠতে পারেননি, এখনও বার্সেলোনার মেসিই থেকে গেছেন_ ঘুরেফিরে পুরনো অভিযোগ উঠছে নতুন করে। তবে ভক্তদের আশ্বস্ত করেছেন স্বয়ং মেসি। তার কথায়, ‘সমালোচকরা যা-ই বলুক না কেন, আমি কখনও পাল্টাব না। বার্সেলোনার হয়ে শিরোপা জিততে যে ভূমিকা রেখেছি, দেশের হয়েও এই বিশ্বকাপে আমি একই ভূমিকা রাখতে চাই।’ তবে বার্সার মেসির সঙ্গে জাতীয় দলের মেসির যে ব্যবধান বিস্তর, সেটা অনুধাবন করা যায় একটি তথ্যেই। স্প্যানিশ লীগে ৩৪ গোল করে ইউরোপিয়ান গোল্ডেন বুট জিতেছেন মেসি। আর জাতীয় দলের হয়ে ৪৪ ম্যাচ থেকে তার গোল মাত্র ১৩।
আর্জেন্টিনার গ্রুপে বাকি দুটি দল এশিয়ান প্রতিনিধি দক্ষিণ কোরিয়া ও গ্রিস। অপেক্ষাকৃত সহজ গ্রুপেই আছেন মেসিরা। আর তাই আর্জেন্টিনা-নাইজেরিয়া ম্যাচটিই এ গ্রুপের নির্ধারক অন্তত এখন পর্যন্ত এমন ধারণাই করছেন ফুটবল এক্সপার্টরা। প্রথম রাউন্ডের হার্ডল আর্জেন্টিনা হয়তো সহজেই অতিক্রম করবে। তবে এ বিশ্বকাপ যখন শুরু হচ্ছে তখন আর্জেন্টিনাভক্তদের সামনে ভেসে উঠছে দীর্ঘদিন ধরে শিরোপা জিততে না পারার ভয়াল স্মৃতিগুলো। গত দু’দশকে একবারের জন্যও বিশ্বকাপের ফাইনালে উঠতে পারেনি ম্যারাডোনার দেশ। গত অলিম্পিক বাদ দিলে সর্বশেষ তারা বড় আসরে শিরোপা জিতেছে ১৯৯৩ সালের কোপা আমেরিকায়।
এবারের আর্জেন্টিনার মূল শক্তি তাদের আক্রমণভাগ। এই দলে আছেন স্প্যানিশ লীগের দুই সর্বোচ্চ গোলদাতা। ২৯ গোল নিয়ে মেসির পেছনে থেকে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গোলদাতা হওয়ার কৃতিত্ব দেখিয়েছেন রিয়াল গোলমেশিন গনজালো হিগুয়াইন। সমানসংখ্যক গোল করে ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগে গোল দেওয়ার ক্ষেত্রে চতুর্থ স্থানে তেভেজ। ইতালিয়ান লীগে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গোলদাতা হলেন দিয়েগো মিলিতো। এমন আক্রমণভাগ থাকার পরও আজ সুপার ঈগলদের বেশ সমীহই করছে আর্জেন্টিনা শিবির। তাদের অভিজ্ঞ মিডফিল্ডার হুয়ান ভেরনের ভাষায়, ‘নাইজেরিয়া বেশ শক্তিশালী দল। প্রথম ম্যাচে আমাদের তারা বিপদে ফেলতে পারে। আর তাই তাদের হারাতে হলে আমাদের সেরা খেলাটিই খেলতে হবে।’