আগে মনে হত না, এখন মনে হয় : মানুষ ও জানোয়ার বটে । গরু, ছাগল, কুকুর, বিড়াল, উট,দুম্বা, জিরাফ, জেব্রা নেকড়ে, হরিণ, খরগোশ, মেষ ,মোষ, বানর হাতি, ঘোড়া, খচ্চর, গাধা, শূকর, শিয়াল সিংহ, বাঘ, হাঙর, কুমির, শুশুক, ভোঁদড় গরিলা, গিবন, শিম্পাঞ্জি, উল্লুক, ভল্লুক, গন্ডার এবং আরো অনেক জন্তু-জানোয়ার আছে পৃথিবীতে ।

মানুষও অনেক রকম-এক এক জন এক এক জানোয়ারের সদৃশ ।জন্তু-জানোয়ারেরই সগোত্র মানুষ-আইনের শাসনের চেয়ে জঙ্গলের নিয়ম পছন্দ করে ।

আজকাল লক্ষ করি,মানুষের সমাজে কিছু মানুষ স্বভাবে আচরণে একেবারে হিংস্র জন্তুর মতো ।
বানরসদৃশ এক প্রাণী পরিবেশের সঙ্গে মিথষ্ক্রিয়া্র মধ্যে উন্নত হওয়ার এবং উন্নত করার জন্য লক্ষ লক্ষ বছর আপন চিন্তাশক্তি ও শ্রমশক্তি খাটাতে খাটাতে নিজের অজান্তেই হয়ে উঠেছে মানুষ ।

বানর, উল্লুক, ভল্লুক, গন্ডার, মোষ, মেষ, সিংহ, বাঘ হাঙর, কুমির ইত্যাদি যে যেখানে ছিল সেখানেই আছে ।
কেবল মানুষ উৎপাদনশক্তি ও সৃষ্টিশক্তির বলে বদলে দিয়েছে এবং বদলে গিয়েছে-
পরিবেশকে উন্নত করেছে সেই সঙ্গে নিজেও উন্নত হয়েছে ।
কিন্তু হায় !আজকাল মনে হয়,পূর্বপুরুষের  সব সম্পদ নিয়ে-দর্শন বিজ্ঞান ইতিহাস সভ্যতা সংস্কৃতি প্রযুক্তি নিয়ে-স্হলে জলে অন্তরীক্ষে বিস্তৃত হয়ে মানুষ দ্রুত নেমে যাচ্ছে জন্তু-জানোয়ারের স্তরে ।
ক্ষুধায়,যৌনতাড়নায়, জিগীষায়,জিঘাংসায় হিংসায়, রিরংসায়, লোভে, লিপ্সায়, ক্ষোভে, নিষ্ঠুরতায় কত আর পার্থক্য বীভৎস

জন্তুর সঙ্গে স্বার্থন্ধ কুটিল মানুষের ?
অলস, নিরীহ, নির্জীব আত্মমর্যাদাবোধহীন মানুষের ?
মানুষ কি আর সংস্কৃতিমান আছে ? মানুষের অমানবিকীকরন চলছে ।
প্রখর দন্ত-নখর নেই বটে মানুষের,তবে আছে দুষ্টবুদ্ধি-
আছে ক্ষেপণাস্ত্র, আণবিক বোমা, হাইড্রোজেন বোমা, রাসায়নিক অস্ত্র
জীবাণু অস্ত্র, পিস্তল, বন্দুক, মেশিনগান, ব্রেইনগান, স্টেইনগান
ট্যাঙ্ক,যুদ্ধবিমান,যুদ্ধজাহাজ,অস্ত্রাগার-আরো কত কি !
মানুষ মানুষকে মারে ।আর কোন প্রাণী স্বজাতিকে মারে ?
হিংস্রতায় অন্য যে কোনো হিংস্র প্রাণীর চেয়ে মানুষ অনেক অনেক অনেক পারঙ্গম ।
ষড়যন্ত্রে,চক্রান্তে,দলাদলিতে মানুষের সমকক্ষ আছে কোনো প্রাণী ?

দিন যত যাচ্ছে মানুষের সম্ভাবনা,হায়,মানুষেই নষ্ট করছে !
বসনিয়া,হারজেগোবিনা,সার্বিয়ার যুদ্ধ-যুদ্ধ আফগানিস্তানে,ইরাকে
ক্রমাগত আক্রমণের হুমকি উত্তর কোরিয়া ও ইরানের প্রতি
কত কাল ধরে মধ্যপ্রাচ্যে অশান্তি,বাস্তুহারা মানুষের কান্না
তেলসম্পদ লুন্ঠণ-বিশ্বব্যাপী সামাজিক অবিচার দ্রুতবর্ধমান ।
এসবেরই প্রতিক্রিয়ায় সহিংসতা-যুক্তরাষ্ট্র নাম দেয় সন্ত্রাস ।
সন্ত্রাস কি ঘটে অকারণেই ? সন্ত্রাসের সব কারণ অব্যাহত রেখে
যুদ্ধ দিয়ে,আইন-আদালতের কঠোরতা দিয়ে, জেল-ফাঁসি দিয়ে
সামাজিক অবিচার সীমা অতিক্রম করলেই ।

একদা বম্কিম লিখেছিলেনঃ

“ব্যঘ্রাদি বৃহৎ জন্তু ছাগাদি
ক্ষুদ্র জন্তুদিগকে ভক্ষণ করে ।রোহিতাদি বৃহৎ মৎস্য
শফরিদিগকে ভক্ষন করে ।জমিদার নামক বড় মানুষ
কৃষক নামক ছোট মানুষকে ভক্ষন করে ।জমিদার
প্রকৃতপক্ষে কৃষকদিগকে উদরস্হ করে না বটে,কিন্তু যাহা
করে তাহা অপেক্ষা হৃদয়শোনিত পান করা দয়ার কাজ ।’’

কোনো ফল কি হয়েছে লেখায় ?বড় মানুষের ছোট মানুষকে ভক্ষণ করা
বন্ধ হয়েছে ?কুলি-কামিনরা,মিন্তি-মাতারিরা,টুকাইরা,বস্তিবাসীরা
এনজিওর ঋনগ্রহিতারা,গার্মেন্টসের মেয়েরা,অফিসের পিয়নেরা,কেরানিরা
কারখানার শ্রমিকেরা,ক্ষেতমজুরেরা,কৃষকেরা দেশব্যাপী কেমন আছে ?

বুদ্ধ, মুসা, জিশু, মুহম্মদ, ‘মহামতি’ আকবর, ফ্রেডরিক ‘দ্যা গ্র্যাট’
মার্কস, লেলিন, মাও, টলস্টয়, গান্ধি, মার্টিন লুথার কিং
কত কথা বলে গেছেন,কত কিছু্ করে গেছেন-
তাঁদের চেষ্টা কি সফল হয়েছে ?
তাঁদের চেষ্টা কি ব্যর্থ হয়ে গেছে ?
শোষণ, নির্যাতন, নিষ্ঠুরতা, হিংসা-প্রতিহিংসা কতটা কমেছে ?
সর্বজনীন কল্যাণচিন্তা, সম্প্রীতি, প্রেমধর্ম বাস্তবায়িত হচ্ছে আদৌ ?

সভ্যতা,সংস্কৃতি কেবল মানুষেরই আছে।ঘরবাড়ি, আসবাবপত্র, বিলাসোপকরণ রাস্তাঘাট, যানবাহন, বাগানবাড়ি, অট্টালিকা, প্রাসাদ, জাদুঘর, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, গবেষণাগার, হাসপাতাল, পার্ক, দুর্গ, স্মৃতিসৌধ, টাওয়ার, মন্দির প্যাগোডা, গির্জা, মসজিদ, এতিমখানা, গ্রন্থাগার, সংবাদপত্র কত কি করেছে মানুষ !

মানুষের আছে মোবাইল ফোন, এফএম রেডিও, টেলিভিশন, ভিসিআর ফ্যান, ফ্রিজ, এয়ার কুলার, কম্পিউটার, ইন্টারনেট, ফ্যাক্স, ই-মেইল ওয়েব সাইট, জীবপ্রযুক্তি, চিকিৎসাবিজ্ঞান, শিল্পকারখানা আবিষ্কার,উদ্ভাবন,উন্নয়ন ।

মানুষের আছে দর্শন,বিজ্ঞান ইতিহাস, সাহিত্য, সঙ্গীত, চিত্রকলা, নাটক, নৃত্য ।
ন্যায় সত্য সুন্দর প্রগতি মানুষেরই উদ্ভাবন ।
মানুষ সৃষ্টি করেছে পরিবার, সমাজ, জাতি, রাষ্ট্র প্রশাসন ব্যবস্হা, বিচারব্যবস্হা, শিক্ষাব্যবস্হা, উন্নয়ন-পরিকল্পনা, ব্যাংক, বীমা
আন্তরাষ্ট্রিক সম্পর্ক, সহযোগিতা, সম্প্রীতি, সঙ্ঘশক্তি, সম্মিলিত প্রয়াস ।
আর কোন প্রাণীর, কোন জন্তুর, কোন জানোয়ারের আছে এসব ?

মানুষ খারাপ করে এবং খারাপ হয় বটে  তবে শেষ পর্যন্ত ভালোর প্রতিই তার প্রবনতা
অনুতাপহীন অপরাধী আর কজন ?
ভালো-মন্দের দ্বন্দ্ব চলে মানুষের মনে-সমাজে রাষ্ট্রে সর্বত্র
তারই মাঝে তার সওা সক্রিয় ।
মানুষ কি কোনো দিন চিরতরে বংশ-পরম্পরায়
সম্পূর্ণ ভালো হয়ে যাবে ?কিংবা যাবে সম্পূর্ণ খারাপ হয়ে ?
মানুষ নিজের জন্য স্বাধীনতা চায়,কিন্তু অন্যকে সে
নিজের অধীন রাখতে চায় ।
মানুষ জন্মে স্বাধীন হয়ে আর জীবন কাটায় শৃঙ্খলিত ।মানুষের সমাজে
কেউ কেউ নিজেকে প্রভু ভাবে,আসলে তারা
প্রভু হয় না,হয় দাসদের চেয়েও বেশি দাস ।
মানুষ প্রেম পেতে চায়,প্রেম দিতে চায় ।মানুষ প্রেমময় এবং প্রেমের ভিখারী ।
তবু অপ্রেম ও নিষ্ঠুরতাই কর্তৃত্ব করে মানুষের সমাজে ।মানুষ
ধ্বংসপ্রবন এবং সৃষ্টিশীল ।ধ্বংশ ও সৃষ্টি দুই-ই আছে মানুষের ইতিহাসে ।
প্রত্যেক জাতির ইতিহাসে দেখা যায়, খারাপকে পেছনে ফেলে মানুষ
কখনো কখনো ভালো হয়ে ওঠে আর পরিবেশকেও ভালো করে তোলে ।
সেই মানুষদের উওরপ্রজন্মই আবার এক সময় খারাপ হয়ে যায়-
পরিবেশকেও খারাপ করে ফেলে ।ভালো-মন্দ মিলিয়ে মানুষ-বড়ই আশ্চর্য !
কোনো কোনো মানুষ একেবারে উই আর ইঁদুরের মতো ।

বাংলা ভাষার এক অবজ্ঞাত কবি হয়তো মানুষের দিকে তাকিয়েই লিখেছিলেনঃ

‘‘উই আর ইঁদুরের দেখ ব্যবহার
যাহা পায় তাহা কেটে করে ছারখার ।’’

বুঝিনা কি করে যে গান্ধি হিংসামুক্ত প্রেমময় মানবজাতির স্বপ্ন দেখতেন মার্কস শোষণমুক্ত ঋদ্ধিমান মানবজাতির স্বপ্ন দেখতেন ।

প্রত্যেক জাতির ইতিহাসে কোনো কোনো সময়কে মনে হয় ‘স্বর্ণযুগ’ আর কোনো কোনো সময়কে ‘অন্ধকার যুগ’ ।
ইতিহাসের গতিধারায় স্বর্ণযুগ আর অন্ধকার যুগ একটির পর অন্যটি পর্যায়ক্রমে দেখা দেয়-ইতিহাস থেমে থাকে না ।
কেবল স্বর্ণযুগ কিংবা কেবল অন্ধকার যুগ চিরস্হায়ী হবে কোনো কালে ?
এখন ভীষণ দুর্গতি মানুষের-বাংলাদেশে এবং গোটা পৃথিবীতে ।
মনে হয় অত্যুন্নত প্রযুক্তি নিয়ে-ভোগের অজস্র উপাদান নিয়ে মানুষ কেবলই নেমে যাচ্ছে নির্বোধ প্রাণীদের পর্যায়ে ইতর প্রাণীদের পর্যায়ে বন্য প্রাণীদের পর্যায়ে ।

বুদ্ধিজীবী,শ্রমজীবী,শিক্ষিত,অশিক্ষিত ধনী,দরিদ্র,শক্তিমান,দুর্বল সবাই বদলে গেছে-
কেউ সুস্হ নেই, স্বাভাবিক নেই,নেই আপন সওায় ।
সবাই নেমে যাচ্ছে-পৃথিবীর সর্বত্র ব্যক্তি, সমাজ, জাতি, রাষ্ট্র নষ্ট হয়ে যাচ্ছে-
যার ক্ষতি করার শক্তি যত বেশি-
তার প্রভাব-প্রতিপওি তত বেশি-
সর্বজনীন কল্যাণবোধ সবত্র অবজ্ঞাত !
ভীষণ বীভৎস রুপ নিয়েছে আন্তঃরাষ্ট্রিক সম্পর্ক-বিশ্বব্যবস্হা !
সবকিছুকে বদলে ফেলতে হবে, ভালো করে তুলতে হবে-এই তো মূল কথা ।

আত্মবিস্মৃত হয়ে, আত্মভ্রষ্ট হয়ে, মানবজাতি আজ আত্মঘাতী পথে চলেছে । ইতিহাসে দেখা যায়-এমন অবস্হা মাঝে মাঝে হয় যখন ব্যক্তি সমাজ জাতি এমনকি গোটা মানবজাতি কৌ্তূহল হারিয়ে বিস্ময়বোধ হারিয়ে-আত্মপরিচয়,আত্মশক্তি,সমাজ,পরিপার্শ্ব সব ভুলে গিয়ে ধ্বংসের পথে চলে ।তারপর একসময় পরিস্হিতির অভিঘাতে আত্মসচেতন হয়ে,আত্মসংবিত ফিরে পেয়ে,সুস্হ হতে চায়  স্বস্হ হতে চায়-নিজের বুদ্ধিতে নিজের শক্তিতে পরিবেশকে পুনর্গঠিত করে এবং উন্নতির পথ ধরে ।

আজকের সঙ্কটে কি আটকে থাকবে মানুষ ?

অনুচিত বিশ্বব্যবস্হা,রাষ্ট্রব্যবস্হা ও জীবনপদ্ধতি নিয়ে
পৃথিবীর সর্বত্র মানুষ অভিযোগমুখর-
অসন্তোষের ভেতর থেকেই আসবে নতুন ইশতিহার-জাগবে ন্যয়কামী সৃষ্টিশীল প্রতিভাবান নতুন মানুষ-অন্যায় সব বিধি-ব্যবস্হা ভেঙে দিয়ে সম্মিলিত প্রয়াসে সৃষ্টি করবে মানবিকীকরণের নতুন সব ব্যবস্হা-
প্রতিষ্ঠা করবে পাশবিক পৃথিবীর বদলে নতুন মানবিক পৃথিবী-
সুখী,সুন্দর,আনন্দময়,ঋদ্ধি্মান করে তুলবে
প্রত্যেকের ও সকলের জীবনকে-
জন্তু-জানোয়ারের পর্যায় থেকে মানুষ উওীর্ণ হবে মানবিক পর্যায়ে-
তখনই মানুষ প্রকৃত মানুষ হবে,এবং শুরু হবে প্রকৃত মানুষের ইতিহাস ।

 

লিখেছেন-
অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় – বাংলা বিভাগ