অবশেষে শেষশয্যা নিলেন মাহবুব আলম। দেশের ইতিহাসের অন্যতম সেরা ও সাফ গেমসের সোনাজয়ী এই অ্যাথলেটের জানাজা গতকাল (সোমবার) বাদ আসর কিশোরগঞ্জের ঐতিহাসিক পাগলা মসজিদ চত্বরে অনুষ্ঠিত হয়। জানাজা শেষে খেলোয়াড়, ক্রীড়াবিদ, সংগঠকসহ অসংখ্য মানুষ তাঁর মরদেহ বয়ে নিয়ে যায় শহরের হয়বতনগর কবরস্থানে, সেখানেই দাফন সম্পন্ন হয়। কফিন থেকে লাশ কবরে নামানোর সময় মাহবুবের স্বজনসহ হাজারো মানুষের কান্নায় এক হূদয়বিদারক দৃশ্যের সৃষ্টি হয়।

গত রোববার রাতে নারায়ণগঞ্জের বন্দর থানায় মাহবুবের স্ত্রী স্বপ্না বেগম বাদী হয়ে অ্যাথলেটিকস ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক মো. শাহ আলম, ফেডারেশনের সদস্য ও কমলাপুর স্টেডিয়ামের সদস্য মো. ইয়াহিয়ার নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত ব্যক্তিদের আসামি করে হত্যা মামলা করার পর আইনি তৎপরতা শুরু হয়।সকালে ফ্যাক্সে বন্দর থানা থেকে লাশের ময়নাতদন্ত করার অনুরোধপত্র আসার পর কিশোরগঞ্জ মডেল থানায় কর্মরত উপপরিদর্শক (এসআই) মো. আহসান হাবিব সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করে লাশ কিশোরগঞ্জ সদর হাসপাতাল মর্গে পাঠান। পরে কিশোরগঞ্জের সিভিল সার্জন কিশোরগঞ্জ আধুনিক সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) মো. আবদুল মজিদের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি ময়নাতদন্ত কমিটি গঠন করেন, কমিটির অন্য দুই সদস্য ছিলেন মোহাম্মদ আলী ও মো. মুকিত।

বেলা আড়াইটায় ময়নাতদন্ত শেষ হয়। ময়নাতদন্ত কমিটি সূত্রে জানা গেছে, আঘাতে মাহবুব আলমের বাঁ পাজর সম্পূর্ণ ভেঙে গেছে। বাঁ যকৃৎ, প্লীহা ও ফুসফুস সম্পূর্ণভাবে নষ্ট হয়ে গেছে। আঘাতজনিত কারণেই মাহবুবের মৃত্যু হয়েছে বলে তদন্তদলের চিকিৎসকেরা জানান।পরে একটি ভাড়া করা অ্যাম্বুলেন্সে মাহবুবের লাশ শহরের হারুয়া এলাকায় তাঁর বাড়িতে নেওয়া হয়। লাশের শেষ গোসল সম্পন্নের পর জানাজার জন্য পাগলা মসজিদ চত্বরে নিয়ে যাওয়া হয়। মসজিদ মাঠে জানাজায় অসংখ্য শোকার্ত মানুষ অংশ নেয়।

দাফনের জন্য লাশ নিয়ে যাওয়ার সময় বাকরুদ্ধ মাহবুবের মা হালিমা খাতুনকে দেখে অনেকেই সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা খুঁজে পাননি। তিনি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলতে থাকেন, ‘আল্লাহ্ আমাকে নিয়ে যেত, মাহবুবকে রেখে যেত।’ মাহবুবের স্ত্রী স্বপ্না বেগমের আহাজারিতে উপস্থিত আত্মীয়স্বজন কান্নায় ভেঙে পড়েন। চার বছরের একমাত্র মেয়ে মীম কেবলই ‘বাবা, বাবা’ বলে চিৎকার করছিল।

প্রসঙ্গত, মাহবুব গত শুক্রবার রাতে অ্যাথলেটিকস ফেডারেশনের সদস্য ও কমলাপুর স্টেডিয়ামের প্রশাসক মো. ইয়াহিয়ার সঙ্গে মাইক্রোবাসে কুমিল্লায় যান। সেখান থেকে শনিবার ভোরে ঢাকায় ফেরার পথে কাঁচপুর এলাকার ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে পিপাসা পেট্রলপাম্পের কাছে মাইক্রোবাসটি দুর্ঘটনায় পড়ে। পরে মাহবুবের লাশ রাস্তায় রেখেই ইয়াহিয়াসহ মাইক্রোবাসে থাকা অন্য যাত্রীরা পালিয়ে যান। শনিবার সকালে খবর পেয়ে মাহবুবের মা ছেলের লাশ আনতে প্রথমে নারায়ণগঞ্জ হাইওয়ে থানায় যান। সেখান থেকে লাশের ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন ছাড়াই ফেডারেশনের কতিপয় কর্মকর্তার উপস্থিতিতে লাশ হস্তান্তর করা হয়। মাহবুবের মৃত্যুর পর থেকেই স্ত্রী স্বপ্না বেগমসহ আত্মীয়স্বজনের সন্দেহ হয়, মাহবুবকে পরিকল্পিতভাবে খুন করা হয়েছে। শনিবার বাদ জোহর লাশ দাফনের কথা কথা ছিল। কিন্তু মাহবুবের স্ত্রী, মা ও আত্মীয়স্বজন ময়নাতদন্ত ছাড়া লাশ দাফন করা হবে না বলে সিদ্ধান্ত নেন। তাঁদের এ সিদ্ধান্তের সঙ্গে কিশোরগঞ্জের মানুষ সহমত পোষণ করে। পরে রোববার সকালেই তাঁরা চলে যান নারায়ণগঞ্জ হাইওয়ে থানায়। ঘটনাস্থল বন্দর থানা হওয়ায় বন্দর থানাতেই সন্ধ্যার পর মামলাটি নথিভুক্ত করা হয়।

নারায়ণগঞ্জ বন্দর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মো. সাইফুল ইসলাম জানান, মামলা দায়েরের পর এ ঘটনার তদন্ত চলছে। ঘটনার সত্যতা পাওয়া গেলে প্রাথমিক তদন্তের পর জড়িতদের শনাক্ত করে তাঁদের গ্রেপ্তার করা হবে।মাহবুবের পরিবারকে বিশেষ ভাতা: বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন (বিওএ) মাহবুবের পরিবারকে প্রতি মাসে ৫ হাজার টাকা করে বিশেষ ভাতা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আগামী তিন বছর পর্যন্ত এ ভাতা বহাল থাকবে।

-Prothom Alo