‘হাসমত আলীর মতো আওয়ামী লীগের সমর্থক যত দিন বাংলাদেশের মাটিতে থাকবে, তত দিন আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করা যাবে না। সারা দেশের এমন হাসমত আলীদের দোয়া আর ভালোবাসার কারণেই আমি সন্ত্রাসীদের গ্রেনেড হামলা থেকে বেঁচে গেছি।’
হাসমত আলীর বিধবা স্ত্রী রমিজা খাতুনকে পাশে বসিয়ে কথাগুলো বললেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একসময় রমিজাকে জড়িয়ে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আপনার আর কষ্ট করতে হবে না। আমি আপনার সব কিছু দেখব।’ রমিজা বলেন, ‘মাগো, তুমারে একনজর দেখার জন্য অনেক ঘুরছি। তুমি আমার সামনে একটু বসো, তুমারে দুই চোখ ভইরা দেখি।’
একজন প্রধানমন্ত্রী ও একজন নিঃস্ব নারীর মধ্যে এমন এক মর্মস্পর্শী দৃশ্যের অবতারণা হয় গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে। দুজন পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে চোখের জলে ভাসিয়ে দেন।
হাসমত আলী ছিলেন বঙ্গবন্ধুর একজন অন্ধভক্ত। রমিজা খাতুন তাঁরই স্ত্রী। ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ের বাড়ইল গ্রামে তাঁদের বাড়ি। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হলে হাসমত আলী পরিবার-পরিজন নিয়ে ঢাকায় চলে আসেন। পরে রিকশা-ভ্যান চালিয়ে তিলে তিলে জমানো টাকা দিয়ে নিজের গ্রামে একখণ্ড জমি কেনেন শেখ হাসিনার নামে। হাসমত আলী বলতেন, ‘শেখ হাসিনা আমার মেয়ে। মেয়েটা এখন এতিম।’ বছরখানেক পর গুরুতর অসুস্থ হয়ে টাকার অভাবে উন্নত চিকিৎসা না পেয়ে হাসমত আলী মারা যান। তবু সেই জমি তিনি বেচতে দেননি। তাঁর স্ত্রী রমিজা এখন ঢাকায় ভিক্ষা করে জীবিকা নির্বাহ করেন।
গত বুধবার কালের কণ্ঠে এ ঘটনা নিয়ে ‘বিরল ভালোবাসা’ শিরোনামে সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে হৈচৈ পড়ে যায়। রমিজা খাতুনের সন্ধানে সারা দিন ফোন আসে কালের কণ্ঠ অফিসে। সকাল থেকে ভিড় লেগে যায় তাঁর বস্তিঘরের সামনে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে রমিজাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ওই দিনই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। গতকাল বৃহস্পতিবার শেখ হাসিনার নির্দেশমতো ওই প্রতিবেদনের রচয়িতা কালের কণ্ঠের নিজস্ব প্রতিবেদক হায়দার আলী রমিজা খাতুনকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে যান। এ সময় তাঁদের সঙ্গে ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর প্রেসসচিব আবুল কালাম আজাদ, বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রাণ গোপাল দত্ত, পরিচালক (হাসপাতাল) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আব্দুল মজিদ ভুঁইয়া প্রমুখ।
রমিজা খাতুন এ সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে তাঁর নামে কেনা জমির দলিল হস্তান্তর করেন। প্রধানমন্ত্রী রমিজার সমস্ত দায়িত্ব গ্রহণের ঘোষণা দেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘বুধবার সকালেই কালের কণ্ঠে প্রতিবেদনটি পড়ে আমি অবাক হই। আওয়ামী লীগের এমন ভক্তও আছেন! আমি সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তিগত সহকারী (২) সেলিমা খাতুনকে বলি দ্রুত রমিজা খাতুনের খোঁজখবর নিতে এবং তাঁকে উন্নত চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তি করাতে।’ এ ছাড়া তিনি তাঁর কার্যালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেন, গফরগাঁওয়ের ওই জমিটি দ্রুত উদ্ধার করে সেখানে হাসমত আলীর কবরটি পাকা করে বাঁধাই করার জন্য। প্রধানমন্ত্রী সেখানে রমিজার জন্য একটি বাড়ি তৈরি এবং গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি পালনের ব্যবস্থা করে দেওয়ার নির্দেশ দেন। এ ছাড়া রমিজা যত দিন বেঁচে থাকবেন, তত দিন তাঁকে প্রতি মাসে ভাতা প্রদানের ঘোষণা দেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন থেকে রমিজাকে আর্থিকভাবে সহায়তা করা হবে বলে তিনি জানান। তাঁর নামে কেনা জমিটি রমিজার নামে ফিরিয়ে দেবেন বলেও প্রধানমন্ত্রী জানান। রমিজা এখন প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকবেন। গফরগাঁওয়ের জমিতে বাড়ি করার পর তিনি সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করবেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ফেরার সময় শেখ হাসিনা নগদ অর্থও তুলে দেন রমিজার হাতে।
গতকাল সকালেই হাসপাতালের পরিচালকের দেওয়া নতুন কাপড়, জুতা পরে রমিজা খাতুন অপেক্ষা করতে থাকেন, কখন যাবেন শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করতে। সাড়ে ১১টায় হাসপাতাল থেকে রওনা দেন তিনি। তাঁর সঙ্গে প্রাণ গোপাল দত্ত, আব্দুল মজিদ ভুঁইয়া ও কালের কণ্ঠের এ প্রতিবেদক। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ঢুকে অতিথিদের কক্ষে বসার পর রমিজাকে একনজর দেখার জন্য সেখানের অনেক কর্মকর্তা ছুটে আসেন। সেখানে রমিজাসহ অন্যদেরও নাশতা দেওয়া হয়। দুপুর দেড়টার দিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অতিথিদের কক্ষে এসে রমিজাকে জড়িয়ে ধরেন। বেশ কিছুক্ষণ দুজন কোনো কথা বলতে পারেন না। দুজনের কান্না দেখে উপস্থিত সবার চোখ ভিজে ওঠে। শেখ হাসিনা রমিজাকে জড়িয়ে ধরে বলেন, ‘আমার কাছে আগে আসলেন না কেন? হাসমত আলীকে যখন হাসপাতালে ভর্তি করানো হলো, সে সময় আমাকে কেন জানাননি?’ রমিজা বলেন, ‘মাগো, অনেকবার চেষ্টা করছি। ধানমণ্ডির বাড়ির সামনে অনেক বসে ছিলাম কিন্তু কেউ তোমার কাছে নিয়া যায় নাই।’
শেখ হাসিনার হাতে জমির দলিলটি দিয়ে রমিজা বলেন, ‘মাগো, জমির দলিল তোমার কাছে রাখো। আমি আর এই জিনিস রাখবার চাই না। আইজ যদি তিনি (হাসমত আলী) বাঁইচা থাকতেন, তাইলে কী খুশি হইতেন! মরার আগেও তোমার জন্য দোয়া করছে। তোমার কিছু হইব না, মা। আল্লায়ই তোমারে বাঁচাইয়া রাখব।’
শেখ হাসিনাকে জড়িয়ে ধরে রমিজা খাতুন একপর্যায়ে মৃত স্বামীর উদ্দেশে বলতে থাকেন, ‘তোমার মেয়ে হাসিনা আমাকে ডেকে খোঁজখবর নিয়েছে। তাঁর জন্য তোমার কেনা জমিতে আমার থাকার ঘর আর খামার করে দিতে চেয়েছে। মেয়ের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে। আমার আর চাওয়ার কিছু নাই।’ রমিজা এ সময় দুহাত তুলে শেখ হাসিনার জন্য দোয়া করেন।
এদিকে ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা খেন চান গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে আমাদের জেলা প্রশাসক ঘটনাস্থলে গিয়ে খোঁজখবর নিতে বলেন। আমি উপজেলার রাওনা ইউনিয়নের বাড়ইল গ্রামে গিয়ে ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করি।’
গফরগাঁওয়ের সংসদ সদস্য ক্যাপ্টেন (অব.) গিয়াসউদ্দিন আহাম্মেদ ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা হেদায়েতউদ্দিন আহাম্মেদ গতকাল সকালে ঢাকায় ছুটে আসেন হাসপাতালে রমিজাকে একনজর দেখতে। সাংসদ গিয়াসউদ্দিন আহাম্মেদ বলেন, ‘হাসমত আলীর নিজের কিছু ছিল না। দলের জন্য প্রীতি ছিল অসম্ভব। তিনি বিরল ঘটনার জন্ম দিয়েছেন। আমরা যারা নিজেদের আখের গোছাতে চেষ্টা করি, হাসমত আলীর কাছ থেকে তাদের শিক্ষা নেওয়া উচিত।’
দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে রমিজার খোঁজ জানতে চেয়ে গতকালও কালের কণ্ঠ অফিসে সারা দিন ফোন আসে। শ্যামলীর কাজি অফিসের পেছনের বস্তিতে রমিজার ঘরের সামনে দূর-দূরান্তের মানুষের ভিড় ছিল।
হাসমত আলী ও রমিজার একমাত্র সন্তান আবদুল কাদের তাঁর তিন সন্তান নিয়ে গতকাল দুপুরে হাসপাতালে আসেন। কিন্তু রমিজাকে না পেয়ে সেখানেই বসে থাকেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে রমিজা হাসপাতালে ফেরার পর কাদেরের বড় ছেলে ১১ বছরের জাফর আলী দাদিকে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘ও দাদি, তুমি নাকি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করছ! তোমারে কী খাইতে দিছে? তারে কি হাত দিয়া ধইরা দেখছ? হেয় কি আমাগো মতো?’
রমিজা নাতিকে বলেন, ‘আমি তার গলায় জড়াইয়া ধরছি। আমার লগে কথা কইছে। ভাই রে, আমারে আর ভিক্ষা করতে হইব না!’