মুক্তিযুদ্ধের দুই বছর আগের কথা। মগল মিয়া নামের এক ব্যক্তি ভৈরব রেলস্টেশন-সংলগ্ন পতিত জমিতে আবাস গড়ে তোলেন। অল্প সময়ের মধ্যে মন্নাফ মিয়া, গফুর মিয়া ও উমর আলী প্রতিবেশী হন মগল মিয়ার। ক্রমে বসতির সংখ্যা বাড়ে।

ভৈরব পৌর শহরের ৩ নম্বর ওয়ার্ডে পুকুরপাড়ের অবস্থান। এখানে প্রায় দেড় শ পরিবারের বাস। এখানে রয়েছে রেলওয়ের একটি পুকুর। পুকুরটির কারণে এটি পরিচিতি পায় পুকুরপাড় হিসেবে। সময়ের পরিক্রমায় পঞ্চবটি এলাকার পুকুরপাড়ের পরিচিতি বাড়ে। কিন্তু বাড়েনি কদর। এটি এখন সবার কাছে মাদকপল্লি কিংবা মাদকের আখড়া হিসেবে অনুসন্ধানে জানা গেছে, ভৈরববাসীর কাছে পুকুরপাড় মর্যাদা হারায় ১৯৯১ সালে। এ সময় ভৌগোলিক সুবিধা ও নির্জনতাকে কাজে লাগিয়ে কিছু মাদক ব্যবসায়ী আস্তানা গড়ে তোলেন পুকুরপাড়ে। ৩০-৪০টি পরিবার ও অর্ধশত ব্যক্তি এখান থেকে মাদক ব্যবসা পরিচালনা করে আসছেন। প্রতি দিন লাখ লাখ টাকার ফেনসিডিল, হেরোইন, গাঁজাসহ বিভিন্ন মাদকদ্রব্য কেনাবেচা হয়।

মাদক নির্মূলে বিভিন্ন সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পুকুরপাড়ে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করে।জানা গেছে, বর্তমানে রত্না বেগম (২৮), রাজন মিয়া (২৬), মাজেদা বেগম (৩৮), রহিমা বেগম (৩৮), হাসান মিয়া (৩২), সুমি বেগম (৩০), আলম মিয়া (২৪), সেলিনা বেগম (৩৪), রেহেনা বেগম (৪৫), রহিমা বেগম (৪০), কালা মিয়া (৫০), সুজি বেগম (৪০), শাহীন মিয়া (৪০), পারভীন বেগম (২৫), মাফি বেগম (৩২), দুলাল ওরফে দুলু ও রমজান মিয়া পুকুরপাড়ে বসবাস করে মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে আসছেন। তবে শুক্রবার র্যাবের অভিযানের পর থেকে এলাকাটি নীরব। অনেকটা জনশূন্য। অভিযোগ আছে, রিকশা শ্রমিক লীগের এক নেতাসহ স্থানীয় কিছু রাজনৈতিক নেতা ও সমাজপতি মাদক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা নেন এবং তাঁদের সহযোগিতা করেন। তবে উপজেলা রিকশা শ্রমিক লীগের সভাপতি জাকির হোসেন বলেন, অভিযোগ সত্য নয়। মাদক ব্যবসায়ীরা স্বয়ংসম্পূর্ণ। তাঁদের কারও সহযোগিতার প্রয়োজন হয় না।

এলাকাবাসী জানান, ওই সব মাদক ব্যবসায়ী ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও আখাউড়া সীমান্ত থেকে মাদকদ্রব্য আনেন। মাদক বহনের জন্য তাঁরা প্রত্যেকে একাধিক শ্রমিক ব্যবহার করেন। বহনে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয় নারীদের। পুলিশের করুণা পেতে নারী মাদকশ্রমিকদের কোলে দেওয়া হয় শিশু। কেউ কেউ শিশু ভাড়াও দিয়ে থাকেন। গাড়ির বিভিন্ন স্থানে লুকিয়েসহ বিভিন্ন কৌশলে মাদকদ্রব্য আনা হয়। পার্শ্ববর্তী নরসিংদী, কিশোরগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ, ঢাকাথেকে ট্রেন ও বাসে করে প্রতিদিন বহু লোক পুকুরপাড়ে এসে মাদক সেবন করে থাকেন। এখান থেকে ঢাকাসহ পাশের বিভিন্ন শহরে মাদক সরবরাহ করা হয়।আর এই পুরো প্রক্রিয়ার সঙ্গে রেলওয়ে পুলিশসহ কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত।

জানা যায়, স্থানীয় যাঁরা প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করেন, মাদক ব্যবসায়ীরা তাঁদের বিরুদ্ধে ধর্ষণ, নারী নির্যাতনসহ বিভিন্ন মামলা ঠুকে দেন। মামলায় জড়িয়ে যাওয়ায় বহু প্রতিবাদী মানুষ মাদক ব্যবসা প্রসঙ্গে পুলিশ ও গণমাধ্যম কর্মীদের কাছে মুখ খুলতে চান না। একই কারণে থমকে গেছে মাদকবিরোধী আন্দোলনও। ৩ নম্বর ওয়ার্ড মাদকবিরোধী সামাজিক আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক বাদল মিয়া বলেন, ‘মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কথা বলায় কমিটির সভাপতি মমতাজ মিয়া ও আমাকে মামলা খেতে হয়েছে।’

ভৈরব থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শাহজাহান কবির বলেন, মাদক ব্যবসাসহ নানা কারণে পুকুরপাড় পুলিশের কাছে অপরাধপ্রবণ এলাকা হিসেবে পরিচিত ছিল। তবে পুলিশি তৎপরতার কারণে বর্তমানে সব কিছু নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বলে তিনি দাবি করেন।

-Prothom Alo