আমি মুক্তিযুদ্ধে যাই মতির জন্য। মতি আমার বুকের ধন। আমার বইনের ছেলে। মতি, মানে মতিউর তখন ২৫ বছরের যুবক। আমাদের এলাকার কমান্ডার রসু এসে মতিউরকে বলল, ‘পাক বাহিনী আইসে পড়ছে। যুদ্ধে যাইতে হইব।’ এই কথা শুনে আমার বুকের ভেতরডায় মোচড় দিয়া উঠল। কন কী! বইনের একমাত্র ছেলে। যুদ্ধ করতে গিয়া যদি মইরা যায়! তখন কী হইব! আমরা বাঁচমু কেমনে! এইডা ভাবতে ভাবতে আমার মনের মইধ্যে কেমন য্যান দিশাহারা দিশাহারা লাগতাছিল। কী করমু ভাইবা পাইতাছি না। কিছু না ভাইবাই আমি কমান্ডাররে গিয়া কইলাম, মতি না, আমি যুদ্ধে যামু। তিনি বললেন, ‘তুমি মাইয়া মানুষ, যুদ্ধে গিয়া কী করবা!’
আমি কইলাম, ‘আপনারা যা কন তা-ই করমু। নইলে গোয়েন্দাগিরি করমু।’ কমান্ডার বললেন, ‘তুমি পারবা?’ আমার চোখের মইধ্যে মতির মুখডা ভাইসা উঠলো। মতিরে বাঁচাইতে হইব। আমি কইলাম, ‘পারমু না ক্যান! না পারার তো কিছু নাই।’ এইভাবে জড়ালাম মুক্তিযুদ্ধে। মুক্তিযোদ্ধাদের খবরাখবর আদান-প্রদান করতাম। কখনো পাটক্ষেতের ভেতর দিয়ে নিকলির ইলোবিয়া বাজার হয়ে যেতাম পুবদা। কখনো করগাঁও, গাগলাই, কিশোরগঞ্জের দানা পাটনি, কইরাইল; কখনো সুগারমিল, ছড়ারচর হাই স্কুল। এভাবেই একাত্তরে বসু বাহিনীর হয়ে গোয়েন্দাগিরির কাজ করতাম। একদিন ছড়ারচর হাই স্কুলের কাছে গিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর কাছে ধরা পড়লাম। জানটা তখন হাতের মধ্যে চলে এল। মনে তবু সাহস হারাইনি। ওরা আমাকে বলল, ‘তুম ঠেরউ।’ তখন আমি দাঁড়ালাম। ওরা বলল, ‘তুম কিদার যাইগা খাটো খাটো বাঙালি?’ তখন আমি বললাম, আমি মুকাম যাই। ওরা বলল, ‘তুম উর্দু জানো?’ আমি বললাম, কুছ কুছ জানি। ওরা বলল, ‘আপ তোমারা বন্ধু হ্যায়’ এই সব বলতে বলতে ওরা আমাকে স্কুলের কাছে নিয়ে গেল এবং বলল, ‘কী খাবে?’ আমি বললাম, গেলাসি খাব। ওরা বলল, ‘গেলাসি কাহা মিলেগা?’ আমি চুপ করে রইলাম। মাথাডা আউলা হইয়া গেছিলগা।
আমাকে ওরা মাংস আর রুটি খেতে দিল। তখন ওরা ওদের ভাষায় কী কী বলছিল, সব বুঝতে পারিনি। খাওয়ার পর কী করে পালাব, চিন্তা করতে লাগলাম। মাথায় একটা বুদ্ধি এল। বললাম, পেট ব্যথা করছে। ওরা বলল, যাও। বাথরুম ছিল দূরে। আমি সুযোগ বুঝে জান নিয়ে পালিয়ে এলাম। ওই সময় আমার বয়স ছিল ৪৫ বছর। আমার স্বামী-সংসার নাই। আমার স্বামীর ‘অভ্যাস’ ভালো ছিল না। তাই আমি তাকে নিজ থেকে ডিভোর্স দিয়েছি। পরে আমি আর বিয়েথা করিনি। ঘৃণা ধরে গেছে পুরুষ মানুষের ওপর। তার কথা বলতে মন চাইছে না। আমার জীবনের কথা বলি। আমি বেঁচে আছি কোনোমতে। এইটা জীবন না।
শেখ হাসিনা প্রথম টার্মে ক্ষমতায় আসার পর মাসে এক হাজার ৫০০ টাকা করে পেয়েছি। বিএনপি এসে ৩০০ টাকা করে দিয়েছে। প্রশিকা থেকে এক হাজার টাকা করে পাচ্ছি প্রতি মাসে। এসব দিয়ে কি আর চলে! কোনো রকমে চলছে। না চললে কী করব? আমার বয়স হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে অসুস্থ হয়ে পড়ি। আমার দেখাশোনার জন্য একটা বুয়া রেখেছি। তাকে টাকা দিতে হয়। ১৫ দিনে সব টাকা শেষ হয়ে যায়। এ জন্য সরকারের কাছে সম্মানীর টাকা আরেকটু বেশি করে চাই। তত্ত্বাবধায়ক সরকার একটা খড়ের ঘর তুলে দিয়েছে। এর আগে হাসিনা সরকার জমির জন্য অর্ডার দিয়েছিল। এরপর খালেদা সরকার এসে নিকলীতে একখণ্ড জমি দিয়েছিল। কিন্তু সেটা অন্য লোকে গণ্ডগোল করে কেড়ে নিয়েছে। আমি গরিব মানুষ। বয়সও হয়েছে। এই বয়সে আমি কী আর করতে পারি!
তাই সরকারের কাছে আমার একটা জিনিস চাওয়ার আছে। আমি পানির বড় কষ্টে আছি। আমার একটা টিউবওয়েল দরকার। আর বাড়ির চারপাশে একটা বাউন্ডারি ওয়াল করে দিলে ভালো হয়। আমার আর কিছুই লাগবে না। তবে আরেকটা বড় দাবি আছে। আমি শেখের বেটি, আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে একটু সাক্ষাৎ করতে চাই। মুক্তিযুদ্ধে বোনের একমাত্র ছেলে মতিউর রহমানকে হারানোর দুঃখের কথা তাঁর কাছে একটু খুলে বলতে চাই। তাঁর কাছে গিয়ে মন খুলে একটু কাঁদতে চাই। যাকে হারানোর ভয়ে আমি মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়েছিলাম, আমার সেই বুকের ধন মতিউর মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছে। ছেলেটার কোনো স্মৃতিফলক হলো না! এইটা আমার বুকের মধ্যে একটা ভারী বোঝার মতো কষ্ট।
আরেকটা কথা হইতাছে, রাজাকারগো ফাঁসি হইব কি না জানতে ইচ্ছা অয়। রাজাকার নিয়া আমার কিছু বলার আছে। এদের শাস্তি দিতে এত দেরি হইতাছে ক্যান? এই সরকারের কাছে দাবি জানাই, রাজাকারগো ফাঁসি দিন। ওদের এত দিন বাঁচায়ে রাখছেন ক্যান? দেশের মইধ্যে ওদের চেয়ে বড় দুশমন আর কেডা আছে, আমি তো জানি না।
পরিচিতি : সখিনা বেগম কিশোরগঞ্জ জেলার নিকলী উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা।
অনুলিখন : শরীফা বুলবুল