হাওর থেকে উৎপন্ন হওয়া বছরের একমাত্র ফসল বোরো ধান পাহাড়ি ঢল ও অকালবন্যায় তলিয়ে যাওয়ায় সুনামগঞ্জের হাওরাঞ্চলে এ বছর শিশুশ্রম বেড়েছে। ছেলেশিশুরা বিদ্যালয়ে না গিয়ে নিজে কিংবা বাবা ও ভাইয়ের সঙ্গে হাওরে মাছ ধরায় ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে। ফলে বিদ্যালয়গুলোতে কমে গেছে ছেলেদের উপস্থিতি। এ কারণে শিক্ষায় অনগ্রসর সুনামগঞ্জের হাওরাঞ্চলে শিক্ষা কার্যক্রমে বিপর্যয়ের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

তাহিরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাহমুদুর রহমান জানিয়েছেন, সম্প্রতি উপজেলার হাওরপারের কয়েকটি বিদ্যালয় পরিদর্শন করে তিনি দেখেছেন, বিদ্যালয়গুলোতে মেয়েদের উপস্থিতি থাকলেও ছেলেদের উপস্থিতি নেই বললেই চলে। শিক্ষক ও স্থানীয় গ্রামবাসীর কাছ থেকে খোঁজ নিয়ে তিনি জেনেছেন, শিশুরা ক্লাসে না এসে মাছ ধরতে হাওরে যাচ্ছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য উপজেলা প্রশাসন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের নিয়ে সভা করেছে। সভায় শিক্ষকদের অভিভাবক ও গ্রামবাসীর সঙ্গে মতবিনিময় ও বাড়ি বাড়ি পরিদর্শন আরও বাড়ানোর ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।

তাহিরপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আনিসুল হক বলেন, ফসলডুবির কারণে অসহায় হাওরের কৃষক পরিবারগুলো খেয়ে বাঁচার জন্য শিশুদের বিদ্যালয়ে না পাঠিয়ে হাওরে মাছ ধরার মতো ঝুঁকিপূর্ণ কাজে পাঠাচ্ছে। এ অবস্থার পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজন প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের রেশনিংয়ের মাধ্যমে খাদ্যসহায়তা ও বিনা সুদে ঋণ দেওয়া।

শনিরহাওর পাড়ের মাড়ালা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি কামাল উদ্দিন বলেন, হাওরাঞ্চলের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে খাদ্যের বিনিময়ে শিক্ষা কর্মসূচি চালু করলে শিশুদের উপস্থিতি নিশ্চিত করা সম্ভব।

নিমাই মণ্ডল (১১) শনিরহাওর পাড়ের সাহেবনগর জালালপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র। সকাল ১০টায় বিদ্যালয়ের শ্রেণীকক্ষে তার থাকার কথা থাকলেও ১৪ জুলাই সাহেবনগর এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, ছোট নৌকা করে তার বাবা কলিন্দ্র মণ্ডলের সঙ্গে হাওরটিতে জাল দিয়ে মাছ ধরছে। একইভাবে শনিরহাওরে মাছ ধরছে দ্বিতীয় শ্রেণীর পিন্টু রায় ও তৃতীয় শ্রেণীর আলাল মিয়া। এ ব্যাপারে কলিন্দ্র মণ্ডলকে (৫০) জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, ‘এই বছর পোলার লেখাপড়া নিয়া ভাবতাছি না, কী খাইয়া বাঁচব, হেইডা ভাবতাছি।’

হাওরটির উত্তর পাড়ে গিয়ে দেখা যায়, বিদ্যালয়ে না গিয়ে মাছ ধরছে বীরজয়লক্ষ্মীধুতমা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র আজিমুল হক, মিজানুর রহমান ও দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্র রতন মিয়া। মহালিয়া হাওরে সুলেমানপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র আজহারুল, জোবায়ের ও দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্র নবীনুরকে মাছ ধরতে দেখা যায়।

সাহেবনগর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সঞ্জয় কুমার দে বলেন, শ্রেণীকক্ষে ছাত্রদের উপস্থিতি কমে গেছে। অভিভাবকদের সঙ্গে বারবার কথা বলেও ছাত্রদের উপস্থিতি বাড়ানো যাচ্ছে না।

সুলেমানপুর বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি রফিক উদ্দিন বলেন, ‘পরিবারের আর্থিক অনটন ঘোচাতে শিশুরা বিদ্যালয়ে না এসে হাওরে মাছ ধরতে যাচ্ছে। আমরা চেষ্টা করেও এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে পারছি না।’

উত্তর শ্রীপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান দীনেশ চন্দ্র তালুকদার বলেন, ফসলডুবি ও নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়া হাওরপারের কৃষকেরা এ বছর ফসলহানিতে ভেঙে পড়েছেন। এ অবস্থায় সবকিছু বাদ দিয়ে তাঁরা শুধু খেয়েপরে বাঁচার চেষ্টা করছেন। উত্তর বড়দল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবুল কাশেম বলেন, এখন প্রয়োজন ফসল হারানো কৃষকদের আর্থিক অবস্থার উন্নয়ন।

তাহিরপুর উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা কামরুজ্জামান বলেন, বিদ্যালয়ে শিশুদের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে মা-সমাবেশ ও বাড়ি বাড়ি পরিদর্শন বাড়ানো হয়েছে। জেলা প্রশাসক মো. ফয়জুর রহমান বলেন, হাওরাঞ্চলের বসবাসকারী কৃষকেরা এমনিতেই অসচ্ছল। এবার ফসলডুবির কারণে পরিবারগুলোতে খাদ্যসংকট দেখা দিয়েছে। এ মুহূর্তে হাওরপারের লোকজন পেট বাঁচানোর চেষ্টা করছে। তিনি জানান, শিশুরা যাতে কয়েক ঘণ্টার জন্য হলেও বিদ্যালয়ে আসে, সে জন্য অভিভাবক সমাবেশ ও শিক্ষকদের বাড়ি বাড়ি পরিদর্শন বাড়ানোর জন্য জেলার সব কটি উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেওয়া হবে।

– গোলাম সারোয়ার, তাহিরপুর (সুনামগঞ্জ)