বাবা- মায়ের ইচ্ছে পূরণের জন্য প্রায় সারাজীবন লেখাপড়া মনোযোগ দিয়ে করতে করতে কখন যে কবিতা লেখা শুরু করলেন, আর সেটা খুব দ্রুতই গানে রূপ নিয়ে তার গলা দিয়ে দারুণ আকর্ষণীয়ভাবে বেরুতে থাকলো যাত্রী ব্যান্ডের ভোকাল তপু সেটা নিজেও খুব ভালো ঠাহর করতে পারেন না। বিস্তারিত লিখেছেন ওমর শাহেদ।

ছেলেবেলা থেকেই এই ছেলেটি নানা ধরণের সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে মন উজাড় করে কাজ করতো। যদিও বাবা লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অবসরপ্রাপ্ত) শামসুদ্দীন আহমেদ চাইতেন তার ছেলেমেয়েরা খুব মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়া করবে, ভালো ফলাফল করে বাবা- মায়ের মুখ উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর করবে। কিন্তু তার তিন ছেলেমেয়ের মধ্যে একদম ছোটটা, মানে তপু. বাকীগুলোর চেয়ে একটু আলাদাই ছিল। সে ভালোবাসতো ছড়া লিখতে। আর এই ছড়া লিখতে লিখতেই সে গান লেখার ভুবনে যাত্রা শুরু করলো।

প্রথম দিকে ছন্দ মিলিয়ে গান লিখতো তপু। আর সারাক্ষণ বসে বসে শুনতো মাইকেল জ্যাকসন, লাকী আলী, অঞ্জন দত্তের গান। নিজের কয়েকটি পছন্দের অ্যালবাম ছিল তার। এগুলোর মধ্যে দলছুটের হৃদয়পুর, অর্থহীনের বিবর্তন খুব প্রিয়। ফলে নিজের গান চর্চায় এই অ্যালবাম আর শিল্পীদেরই গুরু মেনে ছিল তপু। এভাবে দিনের পর দিন যখন তার নিরলস গানের জন্য সাধনা চলছে, তখন বাবা ভাবলেন, ভালো করে লেখাপড়া করার জন্য ছেলেটাকে ক্যাডেট কলেজে পাঠানো দরকার। ফলে তপু বরিশাল ক্যাডেট কলেজে ভর্তি হয়ে গেল। এখানে ভালো খেলোয়াড় হিসেবেও খুব সুনাম কুড়িয়েছিল সে, এর মধ্যে লেখাপড়াটাও বলতে গেলে মনোযোগ দিয়েই করেছিল। যার ফলাফল হলো- ’৯৮ সালে যশোর বোর্ড থেকে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে দশম স্থান অধিকারী। খুশি হয়ে বাবা জানতে চাইলেন, “তোমার কী পছন্দ বলো আমাকে।” সুযোগ পেয়ে ছেলে নির্ভয়ে বলে ফেললো, “আমাকে একটা গিটার কিনে দাও।” বাবা ছেলের কথা মেনে নিয়ে তাকে একটা অ্যাকুস্টিক গিটার কিনে দিলেন। আর সেটা নিয়ে সে সারাক্ষণ গান চর্চা করতে থাকলো সে।

মাঝে তপু পাশ করে ফেললেন এইচএসসি। আর নিজে যেহেতু সাংষকৃতিক কর্মকান্ডে জড়িত থাকতে ভালোবাসেন, ফলে নিজের বিশ্ববিদ্যালয় নর্থ-সাউথ- এর সাংস্কৃতিক সংগঠনে যুক্ত হবার জন্য ভাইভাও দিলেন। তবে কী কারণে যেন ফলে বাদ পড়ে গেলো সে। আর মন খারাপ না করে তপুও লেগে থাকলেন গান বাজনায়। আস্তে আস্তে এই সংগঠনের প্রেসিডেন্ট নিশো ভাইয়ের সাথে তার এক ধরণের যোগায়োগ তৈরি হলো। এখানকার এক সিনিয়র বড় ভাই প্রাঞ্জলও তাকে পছন্দ করলেন। তিনিই পরিচয় করিয়ে দিলেন টনির সঙ্গে। টনি মানে ‘ব্ল্যাক’ এর টনি, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তিনি একটি মিক্সড অ্যালবাম বানাবেন। নাম ‘দৌড়’। এই অ্যালবামের জন্য একটি গান দিতে বললেন তিনি তপুকে। আর তিনিও আগের তৈরি ‘স্বপ্নচূড়া’ নামের গানটা দিয়ে দিলেন। এটা রেকর্ড করার টাকাও তখন তার কাছে ছিল না। বড়ভাই অপুর দেয়া ৬ হাজার টাকা নিয়ে তিনি গানটা রেকর্ড করে জমা দিলেন। এটা ’০৩ সালের শেষের দিকের ঘটনা। তবে টনি ভাই জানালেন, “এটা যেহেতু মিক্সড অ্যালবাম আর ব্যান্ডের গান নিয়ে তৈরি হবে, ফলে তোমাদের ব্যান্ডের নামসহ গানটা দাও।” এক অখ্যাত স্টুডিওতে তোলা বিপু, মিতুল, জেমস আর এমরানের ছবিসহ ‘যাত্রী’ নাম দিয়ে তারা গানটা জমা দিলেন। এক বন্ধু রিয়া নামটা ঠিক করে দিয়েছিলো বলে জানালেন তিনি। এরপর অনেকদিন কেটে গেল।

শেষ পর্যন্ত ’০৪ সালের শুরুর দিকে বেরুলো এই মিক্সড অ্যালবাম। আর রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে গেলেন তিনি। একের পর এক শুভেচ্ছা বার্তায় ভাসতে থাকলেন নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে বন্ধুদের কাছে ‘মাষ্টর’ নামে খ্যাত এই নবীন গায়ক। খুব ভালো গণিত পারার কারণে বন্ধুরা তার এই নাম দিয়েছিল। নিজের গানের সাফল্যে মুদ্ধ হয়ে ‘আল্লাহ প্রদত্ত ক্ষমতা’কে পুঁজি করে গানের জগতে সিরিয়াসলি লেগে থাকার কথা চিন্তা করা শুরু করলেন তপু। আর নিজের ব্যান্ড যাত্রীর কাজও গুছিয়ে নিলেন। চুটিয়ে গাইতে শুরু করলেন নানা আয়োজনে।

এই বিশ্ববিদ্যালয়েই কম্পিউটার সায়েন্সে পড়াকালীন সময়ে তপু ’০৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে নিজের প্রথম সলো অ্যালবাম বের করলেন ‘বন্ধু ভাবো কি’ শিরোনামে। এই অ্যালবাম বের হবার পর চারপাশ থেকে অসংখ্য বন্ধু, গুনগ্রাহীরা একের পর এক ফোন করতে থাকলেন। তখন চারপাশ থেকে শুভেচ্ছার জোয়ারে একেবারে ভেসে যাবার মতো অবস্থা তপুর। এরই মাঝে একদিন ফোন করে বসলেন মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। এই বিখ্যাত পরিচালক তাকে ফোন করে আরো অনেকের মতোই শুভেচ্ছা জানিয়ে জানালেন এই অ্যালবাম তার না কি খুব বেশি পছন্দ হয়েছে। আর পাল্টা ধন্যবাদ জানিয়ে তপু তার নাম্বারটি সেইভ করে রাখলেন ফোন বুকে।

হঠাৎ একদিন ফোন করে ফারুকী তার সঙ্গে দেখা করতে চাইলেন। নিজের কাছের মানুষ বিখ্যাত গায়ক এবং আরেক বিখ্যাত মিউজিক কম্পোজার যথাক্রমে- অর্থহীনের সুমন এবং ফুয়াদকে নিয়ে ধানমন্ডির এক রেস্তোরায় তারা দেখা করলেন। আর এখানে এই কথা সেই কথার পর ফারুকী তাকে বললেন, “আপনি অভিনয় করবেন? আমি একটা নতুন ছবি বানাতে যাচ্ছি। নাম ‘থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার’। আপনাকে এই ছবিতে অভিনয় করতে হবে।” এ কথা শোনার পর একেবারে আকাশ থেকে পড়লেন তপু। তিনি উত্তেজনার ভীড়ে হ্যাঁ না কিছু বলে চলে এলেন সেই অফার সঙ্গে নিয়ে। বন্ধু- বন্ধবরা কথা শুনে জানলেন এই সুযোগ অবশ্যই কাজে লাগানো উচিত। কিন্তু যেহেতু তার আসল পরিচয় একজন গায়কের, ফলে এক ধরণের দ্বিধা কাজ করছিল তপুর মধ্যে। তবে শেষ পর্যন্ত তিনি এই অফার গ্রহণ করলেন এবং অভিনয় করতে শুরু করলেন ‘থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার’ নামে তার জীবনের প্রথম এবং এখনো পর্যন্ত একমাত্র ছবিতে।

‘থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার’ ছবিতে কাজ করাকে জীবনের এক অনন্য অভিজ্ঞতা বলে মনে করেন তপু। এর পেছনে তার যুক্তি হলো- এখানে সবাই খুব কাছের মানুষ হিসেবে কাজ করেছেন। যেন পিকনিক করতে করতেই তারা অভিনয় করেছেন বলে মনে হয়েছে তার। আর ফারুকীর ব্যাপারে তপুর ভাষ্য হলো- “আমি আসলে অভিনয় করতে পারি না। তবে ফারুকী ভাই জানেন কিভাবে একজন আনকোরা মানুষের কাছ থেকেও ভালো অভিনয়টা বের করে আনতে হয়।” তাকে একজন চমৎকার পরিচালক হিসেবেও অভিহিত করলেন তপু।
ছবি শুটিং করতে গিয়ে নানা ধরণের অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হন অভিনেতা- অভিনেত্রীরা। তপুও এর ব্যতিক্রম নন। তিনি যেখানেই অভিনয় করতে গিয়েছেন, সাধারণ মানুষ তাকে দেখতে হামলে পড়েছেন। আর তারা ‘শাকিব খান, শাকিব খান’ বলে চিৎকার করেছেন। তবে এখনো তপু আসলে জানেন না- শাকিবের সঙ্গে তার মিলটা কোথায়!

তিশা, মোশাররফ করিমের সঙ্গে এই ছবিতে অভিনয় করতে গিয়ে খুব ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গেলেও সারাজীবন আসলে তপু মিস করবেন এই ছবির চিত্রপরিচালক সুব্রত রিপনকে। রিপনের সঙ্গে বেশ ভালো একটা সহজ সম্পর্ক হয়ে গিয়েছিল তার। এখনো একা একা থাকলে তপু রিপনের সঙ্গে কাটানো সেই দিনগুলোর কথা আনমনে ভাবেন। আর তার মনে হয়- শুধু ছবিটা করার জন্যই নিজের ভেতরের ঘাতক ব্যাধির কথা সবার কাছ থেকে লুকিয়ে রেখেছিলেন রিপন। মাঝে মধ্যে রিপন সবার কাছ থেকে আলাদা হয়ে যেতেন। তাকে তখন খুঁজেও পাওয়া যেত না। আবার অনেকক্ষণ পর ফিরে এসে তিনি হাসিমুখে কাজ শুরু করতেন। এই মানুষটার কাজের প্রতি নিষ্ঠা আর সহকর্মীদের প্রতি অসীম মমতা সারাজীবন বুকে ধরে বেঁচে থাকবেন তপু।

‘থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার’ হলো মানুষের সমস্যা নিয়ে বানানো একটি ছবি। যেখানে এই সমাজে একা একা বসবাস করা একটি মেয়ের দুঃখ- কষ্টের কথা তুলে আনা হয়েছে। ছবিতে তিনি গায়ক তপুর চরিত্রেই অভিনয় করেছেন। যে কি না ছবির নায়িকা তিশা বিপদে পড়লে তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে। নিজের চরিত্রটি বেশ পছন্দই হয়েছে তার। যদিও তপু ভবিষ্যতে পারতপক্ষে অভিনয় করতে চান না। “কারণ ওটা আমার কাজ নয়”, বলেন তিনি।

ভবিষ্যতে অংকের শিক্ষক হতে চাওয়া এই ছেলেটার আসল কাজ গান গাওয়া। নিজের ব্যান্ডের অ্যালবাম ‘যাত্রী’ ছাড়াও তিনি সলো অ্যালবাম বের করেছেন ‘বন্ধু ভাবো কি?’ আর পাশাপাশি তার সঙ্গে অনিলার জুটি বেশ দাঁড়িয়ে গেছে শ্রোতা মহলে। যদিও জুটি প্রথায় আদৌ কোনো বিশ্বাস নেই তপুর। তিনি ভাবেনওনি অনিলার সঙ্গে কাজ করবেন। ফুয়াদের আত্মীয় এই মেয়েটি বহুদিন বিদেশে থেকে বাংলাদেশে আসলে ফুয়াদই তাদের একত্রে গান করার প্রস্তাব দেন। আর তপু ‘নুপুর’ গানের আরেকটা সিক্যুয়েল তৈরি করে সেটা দ্বৈতকন্ঠে গান। যেটার ফলাফল সবারই জানা।

ভালোবাসার গান গেয়ে বিখ্যাত হওয়ার খুব যন্ত্রণা আছে। একথাটি তপুর! কারণ এখন গড়ে তাকে দিনে ১০০টিরও বেশি ফোন কল পাচ্ছেন। আর তিনি এই সমস্যার সমাধানও করেছেন- অপরিচিত কোনো ফোন কল রিসিভ না করে। যদিও তার ধারণা তার নিজের চেহারা আসলে খুব বেশি ভালো না এবং তিনি খুব লাজুক টাইপের ছেলে। আর মনোযোগ খুব সহজেই কেড়ে নেয়ার কোনো যোগ্যতাও তিনি রাখেন না! তারপরও বেয়াড়া ভক্তদের যন্ত্রণায় এখন তার অসি’র অবস্থা। যেহেতু তিনি গ্রামীন ফোনের সেলস অফিসার হিসেবে চাকুরী করেন, ফলে তার হাতে প্রেম করার মতো খুব বেশি সময়ও যে নেই। কিন্তু ভক্তরা কি আর বোঝে এতোকিছু?