পিলখানা ট্র্যাজেডিতে স্বজনহারা ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা শুনে তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা হয়েও অনেক সময় অশ্রুসিক্ত হয়েছি। কারণ মর্মস্পর্শী সে বর্ণনায় অশ্রু সংবরণ কঠিন হয়ে পড়েছিল। ঘাতকদের লোমহর্ষক বর্ণনা শুনে গা শিউরে উঠেছে। মনে হয়েছিল, মুম্বাই বা হলিউডের কোনো ফিল্মের খলনায়কের কাহিনী শুনছি। কঠিন চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও ৫০০ দিনে দুই শতাধিক কর্মকর্তার নিরলস পরিশ্রমের পর মামলাটির চার্জশিট (অভিযোগপত্র) দাখিল করে এখন স্বস্তিবোধ করছি। গতকাল মঙ্গলবার মালিবাগ সিআইডি দফতরে সমকালকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে এভাবেই প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেন বহুল আলোচিত পিলখানা হত্যাযজ্ঞের ঘটনায় দায়ের করা মামলার প্রধান তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার আবদুল কাহার আকন্দ। তিনি বলেন, হত্যাযজ্ঞের ঘটনায় প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা ছিল হৃদয়বিদারক।

তৎকালীন বিডিআর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদের স্ত্রী নাজনীন শাকিলকে হত্যা করে একই গণকবরে পুরুষ সেনা কর্মকর্র্তাদের সঙ্গে মাটিচাপা দেওয়া হয়। এ ধরনের মর্মস্পর্শী আরও কিছু ঘটনা রয়েছে, যা সত্যি বেদনাদায়ক। যে কোনো মানুষের মনকেই তা নাড়া দেবে।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, পিলখানা হত্যা মামলার তদন্ত শেষ করা ছিল একটি বড় চ্যালেঞ্জ। আমরা এতে সফল হয়েছি বলে মনে করি। এত আসামি, হাজার হাজার আলামত। বাংলাদেশ কেন, বিশ্বের কোনো দেশেই একটি মামলায় এত আসামি আছে বলে জানা নেই। মামলাটির তদন্ত শেষ করে সুষ্ঠুভাবে আদালতে চার্জশিট দাখিল করতে পেরে নিজেকে অনেক হালকা মনে হচ্ছে। প্রাথমিক কাজ শেষ হয়েছে। এখন বিচারের কাজ শুরু হবে।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, রাষ্ট্রের এ বিরাট দায়িত্বটি আমার ওপর বর্তেছিল। দীর্ঘ চাকরি জীবনে পিলখানা হত্যাযজ্ঞ মামলাটির তদন্ত ছিল সবচেয়ে কষ্টসাধ্য। আগে কোনো মামলায় এত আসামি নিয়ে কাজ করতে হয়নি। সিআইডির ২০০ কর্মকর্তা ৫০০ দিন ধরে নিরলসভাবে মামলাটির তদন্তকাজে নিয়োজিত ছিলেন। রাষ্ট্রের এত বড় কাজের অংশীদার হতে পেরে আমি গর্বিত। এক প্রশ্নের জবাবে আবদুল কাহার আকন্দ বলেন, আমরা মনে করি, এত বড় ঘটনায় তুলনামূলকভাবে অনেক কম সময়ের মধ্যেই চার্জশিট দেওয়া হয়েছে।

অনেকের অভিযোগ, পিলখানা ঘটনার প্রকৃত নেপথ্য নায়কদের চার্জশিটে শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি_ এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অত্যন্ত নিখুঁতভাবে খুটিনাটি সব বিষয়ও একাধিকবার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা হয়েছে। কোনো ধরনের পক্ষপাতমূলক কিছু করা হয়নি। প্রকৃত অপরাধীদের যাতে সাজা হয়, সেই চেষ্টাই করা হয়েছে। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়নি, তাদের অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। পুরো কাজটি আমরা সততা ও আন্তরিকতার সঙ্গে করেছি। প্রায় ১ বছর ৪ মাস ধরে তদন্ত শেষে সিআইডি গত সোমবার ৮২৪ জনকে আসামি করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করে।

আবদুল কাহার আকন্দ বলেন, পিলখানা হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ২০০৮ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি লালবাগ থানায় মামলা করা হয়। মামলা করার পর ১ মার্চ আমি মামলার তদন্তের দায়িত্ব পাই। মামলা তদন্তের দায়িত্ব পাওয়ার পর আমি নিজেও কিছুটা চিন্তার মধ্যে ছিলাম, এত বড় কাজ কোন দিকে থেকে আগে শুরু করব। প্রথম পর্যায়ে আলামত সংগ্রহ ও ঘটনাস্থল শনাক্তের কাজ করি। এজন্য প্রায় টানা দুই মাস লেগে যায়। শনাক্ত করা হয় ৬২টি স্পট। যেসব স্পটে ঘটনাগুলো সংঘটিত হয়েছে। তদন্তকাজের জন্য অনেক সময় সকাল থেকে রাত পর্যন্ত সিআইডি কর্মকর্তাদের নিয়ে বিডিআর সদর দফতরে অবস্থান করতে হয়েছে। তদন্তে অন্যান্য বাহিনীর সদস্যরাও সর্বাত্মক সহযোগিতা করেন।

তিনি বলেন, আলামতের পাশাপাশি অস্ত্রের হিসাব মেলানো ছিল কঠিন। কোন কোন অস্ত্র ব্যবহৃত হয়েছে, তা শনাক্ত করা হয়। এক পর্যায়ে সিআইডির নিজস্ব জনবলে কাজ সম্পন্ন করা দুরূহ হওয়ায় ঢাকার বাইরে থেকেও পুলিশ কর্মকর্তাদের ডাকা হয়। তারাও নিরলস পরিশ্রম করেছেন। তথ্য-প্রমাণের পাশাপাশি আসামি গ্রেফতার ও জিজ্ঞাসাবাদ কার্যক্রম চালাতে হয়। দেশের বিভিন্ন স্থানে গ্রেফতার হওয়া আসামিদের পর্যায়ক্রমে ঢাকায় আনা হয়। তথ্য-প্রমাণ, আলামত সংগ্রহ, ঘটনাস্থল শনাক্ত হওয়ার পরপরই শুরু হয় জিজ্ঞাসাবাদ পর্ব। পর্যায়ক্রমে গ্রেফতার করা হয় বেসামরিক নাগরিকসহ ২ হাজার ৩০৭ বিডিআর সদস্যকে। তাদের প্রত্যেককে রিমান্ডে (একাধিকবার) জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। রেকর্ড করা হয় প্রত্যেকের জবানবন্দি।

জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্যাদি যাচাই করার জন্য অনেককে মুখোমুখি জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তিনি বলেন, এ মামলা তদন্তে শুধু সিআইডি নয়, বাংলাদেশের অধিকাংশ থানা পুলিশেরও সহায়তা নিতে হয়েছে। আবদুল কাহার আকন্দ বলেন, মামলা তদন্তের জন্য সিআইডির হলরুমকে কন্ট্রোল রুম হিসেবে তৈরি করা হয়েছিল। এখানে বলতে গেলে ২৪ ঘণ্টাই কাজ করতে হয়েছে। কন্ট্রোল রুমের আলো কখনও নেভেনি। আবদুল কাহার আখন্দ বলেন, তদন্তকালে তিনি নিজে যেমন কোনো ছুটি ভোগ করতে পারেননি, তেমনি তদন্তকাজে অংশগ্রহণকারী কর্মকর্তাদেরও একই অবস্থা ছিল। তদন্তকালে প্রায় প্রতি অফিস দিনে আসামি নিয়ে সিআইডি কর্মকর্তাদের আদালতে যেতে হয়েছে। যাচাই-বাছাই ও সাক্ষ্য-প্রমাণের পর ৮২৪ জনকে চূড়ান্তভাবে চিহ্নিত করা হয়।

তাদের প্রত্যেকের স্থায়ী ঠিকানা নিশ্চিত হওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশের সহায়তা নিতে হয়েছে। কোনো কোনো আসামির ক্ষেত্রে একাধিকবারও তার বাড়ির ঠিকানা নিশ্চিত করতে হয়েছে। এছাড়া পাশাপাশি পিলখানার ঘটনায় প্রায় ৬ হাজার ব্যক্তিকে কমবেশি জিজ্ঞাসাবাদ করতে হয়। এ মামলায় সাক্ষীর সংখ্যা ১ হাজার ২৮৫। তাদের জবানবন্দিও রেকর্ড করতে হয়েছে। আসামি ও সাক্ষীদের জবানবন্দি কর্মকর্তারা হাতে লিখতেন। এরপর তা আবার কম্পিউটারে কম্পোজ করতে হয়েছে।

আরও কিছু মামলার তদন্ত করেছেন
আবদুল কাহার আকন্দ

পিলখানা হত্যা মামলা ছাড়াও বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন আবদুল কাহার আকন্দ। অন্যদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের কাছে ছিনতাইকারীদের হাতে নিহত যুগ্ম সচিব নিকুঞ্জ বিহারী নাথ হত্যা মামলা, মতিঝিলে ছিনতাইকারীর গুলিতে সার্জেন্ট আহাদ হত্যা মামলার চার্জশিট দিয়েছেন তিনি। বহুল আলোচিত ব্যাংক জালিয়াতি মামলায়ও তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে চার্জশিট দিয়েছেন এবং অভিযুক্তদের অনেকেরই সাজা হয়েছে। বর্তমানে তিনি ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলা, কিবরিয়া হত্যা মামলা, বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার অধিকতর তদন্তকাজে নিয়োজিত আছেন।