[ গত মাসের প্রথম সপ্তাহে কানাডা ঘুরে গেছেন ঢাকার সিনিয়র সাংবাদিক হেলাল উদ্দিন।বঙ্গবন্ধুর খুনি নূর চৌধুরী বিষয়ে একটি অনুসন্ধান চালান। আর ঢাকায় ফিরে গিয়ে তৈরি করেন এই প্রতিবেদন।]

দেশে ফেরার আতংকে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছেন বঙ্গবন্ধুর ঘাতক লে. কর্নেল (অব.) এসএইচএমবি নূর চৌধুরী। কানাডার ফেডারেল কোর্ট তাকে দ্রুত ডেপোর্ট (জোরপূর্বক বহিষ্কার) করার আদেশ দিয়েছেন। নূর চৌধুরী কানাডার প্রশাসনিক রিভিউ কমিটির কাছে এ রায় পুনর্বিবেচনার জন্য আপিল করেছেন। এতে তিনি বলেছেন, আমি ভীতসন্ত্রস্ত। বাংলাদেশে গেলেই আমার ফাঁসি কার্যকর করা হবে। কিন্তু ফেডারেল কোর্ট তার রায়ে বলেছেন, ‘নূর চৌধুরী মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করেছেন। নারী ও শিশুসহ একটি দেশের জাতির জনককে সপরিবারে হত্যা করেছেন বলে তার বিচার হয়েছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালও বলেছে, এ বিচার স্বচ্ছ ও আইননানুগভাবে হয়েছে। কাজেই এ ধরনের অপরাধীকে কানাডায় অবৈধভাবে বসবাস করতে দেয়া যায় না। তাকে অবিলম্বে বহিষ্কার করতে হবে।’ সপ্তাহব্যাপী কানাডায় অবস্থানকালে নূর চৌধুরীকে বাংলাদেশে ফেরত আনার সম্ভাবনা নিয়ে দায়িত্বশীল একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেছেন এই প্রতিবেদক।

সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, কানাডা সরকার এখনই নূর চৌধুরীকে বাংলাদেশের হাতে তুলে দেবে না। তবে বিচারাধীন নূরের আপিল আবেদন নাকচ হলেই তাকে অন্য দেশে বহিষ্কারের সুযোগ সৃষ্টি হবে। তার আগে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক এ আসামিকে জোরপূর্বক বাংলাদেশে ফেরত (ডেপোর্ট) পাঠাতে অস্বীকার করেছিল কানাডা সরকার। যদিও কানাডার আইনমন্ত্রীর বিশেষ ক্ষমতা আছে যে দেশ, কমিউনিটি ও নাগরিকদের বসবাসে ক্ষতিকর বা বিপজ্জনক যে কোন বিদেশীকে যে কোন সময় বহিষ্কার করা যাবে।

সূত্র মতে, ডিসেম্বরের মধ্যেই কানাডার প্রশাসনিক রিভিউ কমিটির আদালত নূরের আপিল বিষয়ে রায় দেবেন। রায় যাতে দ্রুত হয় সেজন্য বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধে কানাডার সংশ্লিষ্ট দফতর বিষয়টির তদারকি করছে। ফেডারেল কোর্টের রায়ের পর প্রশাসনিক রিভিউ কমিটির আদালতে নূরের আপিল মামলা খারিজ হয়ে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। নূরের আপিল প্রত্যাখ্যান করা হলে যেখানে মৃত্যুদণ্ড নেই এমন যে কোন দেশে তাকে বহিষ্কার করতে হবে। তখন ওই দেশের সঙ্গে সমঝোতার মাধ্যমে নূরকে দেশে এনে ফাঁসি কার্যকর করার জোরালো সম্ভাবনা রয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো দাবি করেছে।

প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধ সত্ত্বেও : বঙ্গবন্ধুর বুকে সরাসরি গুলিবর্ষণকারী এই ঘাতককে যে কোন মূল্যে দেশে এনে ফাঁসির দণ্ড কার্যকর করতে চায় সরকার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুরোধে এর আগে কানাডা সরকার তাকে ফেরত দেয়ার উদ্যোগ নিলেও আইনি বাধার কারণে তা সম্ভব হয়নি। প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে কানাডা সরকারের সঙ্গে দু’দফা কথা বললেও তারা বলেছে, আইনি প্রক্রিয়া নিষ্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত কিছুই করণীয় নেই। তবে কানাডা কোনভাবেই তাকে আশ্রয় বা প্রশ্রয় দেবে না।

এদিকে নূরের ফাঁসির দণ্ড কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া যায় কিনা সে বিষয়টি বিবেচনা করার জন্যও কানাডা সরকারের পক্ষ থেকে প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল বলে জানা গেছে। কিন্তু তা বিবেচনার সুযোগ নেই বলে বাংলাদেশ সরকার সরাসরি ওই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে।

জাতিসংঘের সদস্য পদে সমর্থন : জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য প্রার্থী কানাডাকে সমর্থনের বিনিময়ে নূরকে ফেরত পাঠানোর সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছিল বলে দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে। কিন্তু ১২ অক্টোবর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বাংলাদেশের সমর্থনের পরও কানাডা পর্তুগালের কাছে ১৫০-৩২ ভোটের ব্যবধানে হেরে যাওয়ায় সে সম্ভাবনা অনেক কমে গেছে। এ সমর্থনের বিপরীতে বাংলাদেশ খুনি নূরকে ফেরত দিতে কানাডা সরকারের সহায়তা চাইলে তারা ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করে। এ নিয়ে জাতিসংঘে নিয়োজিত বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি ড. একে আবদুল মোমেন কানাডার পররাষ্ট্রমন্ত্রী লরেন্স কেনন এবং জাতিসংঘে নিয়োজিত কানাডার স্থায়ী প্রতিনিধির সঙ্গে দু’দফা বৈঠক করেছেন বলে জানা গেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নিউইয়র্কের জাতিসংঘ স্থায়ী মিশনের দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, প্রধানমন্ত্রীর নিউইয়র্ক সফরকালে নূর চৌধুরীর বিষয়ে কানাডা সরকারের মনোভাব তাকে অবহিত করা হয়েছে। তিনি এ নিয়ে কানাডা সরকারের সঙ্গে কথা বলার জন্য পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে দায়িত্ব দিয়েছেন। কানাডা সরকারের সঙ্গে নূর ইস্যুতে সমঝোতার জন্য পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনির যে কোন সময় কানাডা সফরের সম্ভাবনা রয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। তবে বিষয়টি স্পর্শকাতর হওয়ায় দায়িত্বশীল নীতিনির্ধারকরা এ নিয়ে মুখ খুলতে চাননি।

জাতিসংঘে নিয়োজিত বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি ড. একে আবদুল মোমেন জানিয়েছেন, কানাডার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও স্থায়ী প্রতিনিধির সঙ্গে সেপ্টেম্বরের শেষে এবং চলতি অক্টোবরের প্রথম দিকে দু’দফা বৈঠক হয়েছে। কানাডা সরকার এ বিষয়ে আমাদের সর্বোচ্চ সহযোগিতা করে যাচ্ছে। আদালতের সিদ্ধান্তের পর অচিরেই খুনি নূরকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো সম্ভব হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন। এ দেশের আইনের কারণেই নূরের বিষয়টি নিষ্পত্তি হতে দীর্ঘ সময় লাগছে মন্তব্য করে ড. মোমেন বলেন, কানাডা সরকার স্পষ্টভাবে বাংলাদেশকে আশ্বাস দিয়েছে, নূরের মতো অপরাধীকে শেল্টার বা আশ্রয় দিতে তারা কোনভাবেই রাজি নয়।

তবে অভিযোগ পাওয়া গেছে, নূরের মামলা দ্রুত নিষ্পত্তিতে কানাডার বাংলাদেশ হাইকমিশনের ভূমিকা অস্বচ্ছ ও অস্পষ্ট। কানাডিয়ান কমিটি ফর হিউম্যান রাইটস ইন বাংলাদেশের আহ্বায়ক ড. মোজাম্মেল হোসেন খানও এ প্রতিনিধির কাছে অভিযোগ করে বলেছেন, মূলত হাইকমিশনের গাফলতির কারণেই নূরের দেশে ফেরার বিষয়ে দীর্ঘ সময়েও অগ্রগতি হয়নি।

আইনমন্ত্রীর দাবি সত্ত্বেও : প্রসঙ্গত. গত বছরের নভেম্বরে কানাডায় ১০ দিনের সফর শেষে দেশে ফিরে আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ দাবি করেছিলেন, ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক এই আসামিকে অচিরেই বাংলাদেশে ফেরত পাঠাবে কানাডা। আইনমন্ত্রী আরও বলেন, অবৈধভাবে কানাডায় অবস্থানরত নূর চৌধুরীর জব্দ করা পাসপোর্টটি বর্তমানে বাংলাদেশের হাইকমিশনারের কাছে রয়েছে। এখন প্রতি সপ্তাহে একবার পুলিশের কাছে তাকে রিপোর্ট করতে হচ্ছে। কিন্তু এ প্রতিনিধি কানাডার একাধিক দায়িত্বশীল সূত্রে খোঁজ নিয়ে জেনেছেন, পুলিশের নজরদারিতে থাকা কিংবা সপ্তাহে সপ্তাহে হাজিরা দেয়ার খবরের কোন বাস্তবতা নেই।

পররাষ্ট্র সচিব মোহাম্মদ মিজারুল কায়েস এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, ‘খুনিদের দেশে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া চলছে। পুরো বিষয়টি সংবেদনশীল হওয়ায় কিভাবে আমরা তাদের দেশে ফিরিয়ে আনব, সেটা এখনই বলতে চাই না।’

নূরই বঙ্গবন্ধুর ঘাতক : বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার সাক্ষ্য-প্রমাণে নিশ্চিত হওয়া গেছে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মেজর ডালিম ও মেজর নূর চৌধুরী সরাসরি স্টেনগানের গুলিতে হত্যা করে। এজন্য সরকার এ দুই খুনিকে যে কোন উপায়ে দেশে এনে ফাঁসি কার্যকরে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, নূর চৌধুরীর রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন অন্তত পাঁচবার প্রত্যাখ্যান করা হয়। ভিজিটর ভিসা নিয়ে নূর চৌধুরী ১৯৯৬ সালের মাঝামাঝি সময়ে কানাডা আসেন। এর কিছুদিন পরই তিনি রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়ে আবেদন করেন। ১৯৯৯ সালে তার আবেদনের ওপর শুনানি হয় এবং প্রাথমিক শুনানিতেই তার আবেদন বাতিল হয়ে যায়। এরপর ২০০২ সালে আরেক দফা শুনানি হলেও তার আবেদন গ্রহণ করা হয়নি। পরে ২০০৪ সালে, ২০০৫ সালে এবং ২০০৬ সালে পর্যায়ক্রমে তার সবক’টি আবেদনই নাকচ করে দেয়া হয়। ওই সময়ই কানাডায় বাংলাদেশের তৎকালীন হাইকমিশনার আমিনুল ইসলাম নূর চৌধুরীকে বাংলাদেশের হাতে তুলে দিতে ফেডারেল সরকারের কাছে আবেদন করেন। কিন্তু তা বিবেচনায় আনার সুযোগ নেই বলে জানিয়ে দেয়া হয়। সর্বশেষ ২০০৭ সালের এপ্রিলে ইমিগ্রেশন অ্যান্ড রিফিউজি আপিল বোর্ড তার বাংলাদেশে হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার কারণে তার রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন নাকচ করে দেয়। কিন্তু একই সঙ্গে রায় দেয়া হয় যে নূর চৌধুরীকে বাংলাদেশ সরকারের হাতে তুলে দেয়া যাবে না।

ওই সময়ই ইন্টারপোলের অটোয়া অফিস থেকে ফ্যাক্স করে কানাডা বর্ডার এজেন্সিসের ওয়ার ক্রাইম অ্যান্ড পাবলিক সেফটি বিভাগকে জানানো হয়, বাংলাদেশে তার মৃত্যুদণ্ডের আদেশ থাকায় তাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হচ্ছে না। মৃত্যুদণ্ডের প্রতি ভবিষ্যতে কানাডা কিংবা বাংলাদেশের দৃষ্টিভঙ্গি এবং নীতিমালার পরিবর্তন হলে তখন এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নেয়া হবে।