২৩ মৃতদেহ উদ্ধার, নিখোঁজ অন্তত ২০, তল্লাশি চলছে

রাজধানীর বেগুনবাড়ীতে ধ্বংসস্তূপ থেকে উদ্ধার হচ্ছে একের পর এক লাশ। মঙ্গলবার রাতে কয়েকটি টিনশেড বাড়ির ওপর পাঁচতলা ভবন ধসে পড়ার ঘটনায় নিহতের চূড়ান্ত সংখ্যা নিরূপণ না হলেও গতকাল বুধবার রাত পর্যন্ত উদ্ধার হয়েছে ২৩টি লাশ। আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে ২১ জনকে। ধ্বংসস্তূপের নিচে আরো অন্তত ২০ জন আটকে আছেন বলে স্থানীয় বাসিন্দারা দাবি করছেন। মর্মান্তিক এ দুর্ঘটনার শিকার পরিবারগুলোর সদস্যদের মাতমে ভারী হয়ে উঠেছে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলের ঝিলপাড় এলাকা। নিহতদের মধ্যে ৯ জন নারী ও ছয়টি শিশু রয়েছে। কয়েকটি পরিবারের একাধিক সদস্যও প্রাণ হারিয়েছেন। রাত ১টার দিকে উদ্ধার হয়েছে আছিয়া (৩) নামে এক শিশুর লাশ।
এদিকে সেনাবাহিনী, ফায়ার সার্ভিস, রেড ক্রিসেন্ট ও রোভার স্কাউটের পাঁচ শতাধিক কর্মী উদ্ধার তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন। এখনো আটকে পড়াদের জীবিত উদ্ধারের সম্ভাবনা নাকচ করছেন না তাঁরা। ঘটনার পর ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে আর্তচিৎকার শোনা গেলেও গতকাল দুপুরের পর থেকে কারো সাড়া-শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। বাঁশ, কাঠ ও টিন দিয়ে তৈরি তিনটি দোতলা বাড়ি ঝিলের পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় সেখানে পেঁৗছতে পারছেন না উদ্ধারকারীরা। বহুমুখী প্রতিকূলতার কারণে উদ্ধারকাজ শেষ হতে দুই-তিন দিন লাগতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন। গত রাত ১১টায় ধসে পড়া ভবন ভেঙে উদ্ধারকাজ চালানো হয়।
মধ্য বেগুনবাড়ী পোস্ট অফিস ঢালের ঝিলপাড় এলাকায় গতকাল দিনভর ছিল হাজার হাজার মানুষের ভিড়। উদ্ধারকর্মীদের সঙ্গে কাজ করছেন স্থানীয় অনেকেও। দিনে ও রাতে কয়েক দফা তুমুল বৃষ্টিতে উদ্ধারকাজ বিঘ্নিত হয়েছে। র‌্যাব ও পুলিশের বিশেষ টিম এলাকার নিরাপত্তা জোরদার করেছে।
তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার ওসি ওমর ফারুক জানান, ‘রাত পৌনে ১১টার দিকে বেগুনবাড়ীর পোস্ট অফিস গলির ১৮/বি নম্বর বাড়িটি ধসে পড়ার সংবাদ পাই। নাজুক ভবনটি পাশের কয়েকটি দোতলা ও তিনতলা টিনশেড বাড়ির ওপর পড়ে। আর তাতেই পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নেয়। নিহতদের বেশির ভাগই টিনশেড ঘরগুলোর বাসিন্দা।’
এলাকাবাসী জানান, কয়েক বছর আগে আব্বাস উদ্দিন ঝিলের ওপর শুধু পিলার দিয়ে দোতলার ফাউন্ডেশন দিয়ে গড়ে তোলেন চারতলা বাড়ি। কিছুদিন আগে আব্বাসের ছেলে জাফর ইকবাল ডালিম বাড়ির পঞ্চম তলার কাজ শুরু করেন। নির্মাণকাজের জন্য ইট-সুরকি তোলা হয় ছাদের ওপর। এ নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার আগেই মঙ্গলবার রাতে পুরো ভবন ধসে পড়ে। বাড়িটির চারপাশে ছিল বেশ কিছু দুই ও তিনতলা টিনশেড বাড়ি। পাঁচতলা ভবনটি ধসে টিনশেড বসতির ওপর পড়লে সে ঘরগুলোর বাসিন্দারা ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়েন। হতাহতের অধিকাংশ ঘটনা ঘটেছে টিনশেড ঘরগুলোতেই। পাঁচতলা ভবনের বেশির ভাগ বাসিন্দা আগেই বাইরে বেরিয়ে যেতে সক্ষম হন।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, মঙ্গলবার রাত সোয়া ১০টার পর থেকে ভবনটি হেলে পড়তে থাকে। সম্পূর্ণ ধসে পড়ার আগে বেরিয়ে যাওয়ার কিছুটা সময় পান ওই ভবনের বাসিন্দারা। আর টিনশেড ঘরগুলোর বাসিন্দারা অধিকাংশই রাতে কর্মস্থল থেকে ফেরেন। ঘটনার সময় নারী ও শিশুরা ঘরগুলোতে ঘুমন্ত অবস্থায় ছিল। পাঁচতলা ভবনটি ঢেউটিন দিয়ে তৈরি চারটি টংঘরের ওপর গিয়ে পড়লে সবকিছু ঝিলের পানিতে তলিয়ে যায়। এ সময় নারী ও শিশুদের গগনবিদারী চিৎকারে এলাকার পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠে। বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে পুরো এলাকা। এ অবস্থার মধ্যেও যাঁরা বের হতে পেরেছেন, তাঁরা জড়ো হন ঝিলের পাড়ে। এলাকার লোকজন আহতদের উদ্ধার করতে ব্যর্থ হয়ে সংবাদ দেন ফায়ার সার্ভিসে। সারা রাত উদ্ধারকাজ চালিয়েও অনেকের সন্ধান না মেলায় শুরু হয় স্বজনদের কান্নার রোল। ভোরের আলোয় পুরোদমে উদ্ধার কাজ শুরু হলে বেরিয়ে আসতে থাকে লাশ। বালি-কাদায় একাকার লাশগুলো শনাক্ত করতে বেশ বেগ পেতে হয়। আঘাতে অনেকের শরীর ক্ষত-বিক্ষত হয়ে পড়ে।
হঠাৎ বিকট শব্দ : ধসে পড়া ভবনের নিচতলার বাসিন্দা নজরুল ইসলাম জানান, হঠাৎ বিকট শব্দে ভবনটি ধসে পড়ে। পরে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা তাঁকে গ্রিল কেটে উদ্ধার করেন। ভবনের ভেতরে থেকে ভয়াবহতা বোঝা যায়নি।
ক্ষতিগ্রস্ত টিনশেড ঘরের বাসিন্দা মোফাজ্জল হোসেন জানান, ঘটনার সময় তিনি বাইরে ছিলেন। ঘরে ছিলেন স্ত্রী শারমিন আক্তার, তাঁর পাঁচ বছরের মেয়ে মেঘনা, দেবর এজেন, ভাগ্নি সান্ত্বনা ও বড় ভাই আজিজুল ইসলাম। ফিরে তিনি দেখতে পান, ঘরের কোনো চিহ্ন নেই। এরপর পানির নিচ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে তাঁদের পাঁচটি লাশ। পরিবারের পাঁচ সদস্যকে হারিয়ে মোফাজ্জল এখন পাগলপ্রায়।
দিনমজুর আশরাফ আলী (২৮) গতকাল দিনভর পাগলের মতো খুঁজেছেন তাঁর স্ত্রী ও সন্তানকে। টিনের তৈরি দোতলা ঘরের একটি রুমে তাঁর পরিবারের চার সদস্য ছিল বলে তিনি জানান। গতরাত পর্যন্ত কারো লাশ উদ্ধার করা যায়নি।
নিখোঁজ ২০ : এলাকাবাসী দাবি করছেন, এখনো নিখোঁজ মানুষের সংখ্যা কমপক্ষে ২০। দরিদ্র পরিবারের অনেক সদস্য সেখানে ছিলেন, যাঁদের স্বজনরা ঘটনার সংবাদও জানেন না। পরিবারের সবাই আটকা পড়ায় তাঁদের খোঁজার মতোও কেউ নেই। ভবনগুলোর মালিকরা তাঁদের ভাড়াটিয়াদের প্রকৃত তথ্য দিলে নিখোঁজ ব্যক্তিদের ব্যাপারে ধারণা পাওয়া যেত বলে উদ্ধারকর্মীরা জানান। ঘটনার পর বাড়িগুলোর মালিকরা পলাতক থাকায় অনেক তথ্য জানা সম্ভব হচ্ছে না।
যাঁরা নিহত : গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত উদ্ধার করা ২২টি লাশের মধ্যে ১৯ জনের পরিচয় মিলেছে। তাঁরা হলেন মোফাজ্জল হোসেনের স্ত্রী শারমিন (২৮), তাঁর মেয়ে সান্ত্বনা (১৭), ছোট মেয়ে মেঘনা (৫), ছোট ভাই এজেন (২৩) ও বড় ভাই আজিজুল ইসলাম ওরফে বাবু (৩২), ওসমান (৪৫), তাঁর স্ত্রী লিপি বেগম (৩০) ও শ্যালিকা হাওয়া (১৬), ইমাম হাসান ওরফে ইমন (২৫) ও তাঁর স্ত্রী কল্পনা (১৮), নজরুলের স্ত্রী জাহানারা (২৫) ও ছেলে জিহাদ (৮), মমতাজ বেগম (৩৫), মোর্শেদা বেগম (২৬), মনিজা ওরফে মঞ্জিলা বেগম (১৮), রবিউল আওয়াল (৩০), সাহেরা খাতুন (২৫), আলমগীরের তিন মাসের সন্তান ফালাইনা ও পাঁচ বছরের শাওন।
ঢাকা জেলার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ আল আমীন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘নিহতদের মধ্যে যাঁদের পরিচয় মিলেছে, তাঁদের স্বজনের কাছে লাশ হস্তান্তর করা হয়েছে। প্রতিটি লাশ সৎকারের জন্য জেলা প্রশাসন থেকে ২০ হাজার টাকা করে সহযোগিতা দেওয়া হচ্ছে। ঘটনা পর্যবেক্ষণে জেলা প্রশাসকের তরফ থেকে একটি কন্ট্রোল রুম স্থাপন করা হয়েছে।’
উদ্ধারকাজ : ঘটনার পরপরই উদ্ধার তৎপরতা শুরু করেন সেনাবাহিনী ও ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা। সেনাবাহিনীর ১৬ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্যাটালিয়নের একটি প্লাটুনসহ শতাধিক সেনা সদস্য উদ্ধার কাজে অংশ নেন। ফায়ার সার্ভিসের ১৫০ সদস্য রয়েছেন সার্বক্ষণিক উদ্ধার তৎপরতায়। উদ্ধারকর্মীরা ঘরগুলোর ভগ্নাংশ সরাতেই একের পর এক লাশ পানিতে ভেসে উঠছে। একেকটি লাশ দেখে ছুটে যান তাঁদের স্বজনরা। তাঁদের গগনবিদারী চিৎকারে উদ্ধারকর্মীরাও থমকে যান কিছু সময়ের জন্য। দুর্ঘটনাস্থলের আশপাশে উদ্ধারকাজে ব্যবহারের জন্য ভারী যন্ত্রপাতি নেওয়া যাচ্ছিল না। সরু পথের কারণে কোনো যানবাহনও সেখানে ঢোকানো সম্ভব হচ্ছে না। বিকল্প পথ দিয়ে সেখানে পেঁৗছে এবং ঝিলে বালি ফেলে কিছু যন্ত্রপাতি নেওয়া সম্ভব হয়েছে।
উদ্ধারকাজে নিযুক্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবু সাঈদ মোহাম্মদ মাসুদ বলেন, ‘ঘটনার সময় হাতির ঝিল প্রকল্প এলাকায় অবস্থান করার কারণে সেনাবাহিনীর উদ্ধারকর্মীরা দ্রুত ঘটনাস্থলে পেঁৗছতে পেরেছেন। মূল ভবনটির নিচে তিনটি টংঘর পুরোপুরি চাপা পড়েছে। আমরা যতটুকু সম্ভব ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে আহতদের উদ্ধারের চেষ্টা করছি। সে জন্য অনেক সতর্কতা অবলম্বন করতে হচ্ছে।’
ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক শাহজালাল জানান, উদ্ধারকাজ কখন শেষ হবে, তা এ মুহূর্তে বলা সম্ভব নয়। নানা প্রতিকূলতা রয়েছে। প্রয়োজনীয় আরো যন্ত্রপাতি আনা হচ্ছে।
ঘটনাস্থল পরিদর্শন : দুর্ঘটনার পর ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়র সাদেক হোসেন খোকা, স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবীর নানক, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী আব্দুল মান্নান, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব, স্থানীয় সংসদ সদস্য, ঢাকার জেলা প্রশাসক ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। পূর্ত প্রতিমন্ত্রী সাংবাদিকদের জানান, যেখানে দুর্ঘটনা ঘটেছে, তা হাতিরঝিল প্রকল্পের জায়গা। এটি কোনোভাবেই ভবন নির্মাণের জন্য উপযুক্ত ছিল না।
সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার লেফটেন্যান্ট জেনারেল আবদুল ওয়াদুদ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে উদ্ধারকর্মীদের প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেন।
তদন্ত কমিটি ও মামলা : ভবন ধসে পড়ার কারণ উদ্ঘাটন করতে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। কমিটির আহ্বায়ক হলেন রাজউকের পরিচালক (উন্নয়ন) শেখ আবদুল মান্নান। সদস্যরা হলেন মো. খালেকুজ্জামান ও আমিনুল ইসলাম। এ ছাড়া ধসে পড়া ভবনের মালিক জাফর ইকবাল ডালিমকে আসামি করে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় একটি মামলাও করেছে রাজউক।