মামাতো বোন রাজিয়া সুলতানা স্মৃতিকে আপন বোনের মতোই নিজ বাসায় আশ্রয় দিয়েছিলেন ফারজানা কবির রিতা। পড়াশোনা, থাকা-খাওয়া, হাতখরচ থেকে শুরু করে আদরের কোনো কমতি ছিল না। বিশ্বাস, গভীর মমতা আর স্নেহের বন্ধনে স্মৃতিকে আবিষ্ট করে রেখেছিলেন রিতা। কিন্তু পারিবারিক মূল্যবোধ আর বিশ্বাসে পেরেক ঠুকে রিতার সাজানো সংসার তছনছ করে দিল স্মৃতি। দেরিতে হলেও বুঝতে তা পেরেছিলেন রিতা। কিন্তু ততদিনে ভেঙে চুরমার হয়ে যায় প্রেম-ভালোবাসায় পূর্ণ রিতা-রাশেদুলের ১৮ বছরের সাজানো সংসার। রিতার জীবনে কাল হয়ে দাঁড়ায় শ্বশুর-শাশুড়ি ও দুই ননদও। শ্বশুর বাড়ির পক্ষ থেকে দেওয়া হয় বাড়ি ছাড়ার আলটিমেটাম। স্মৃতিকে বাড়িতে তোলার জন্য রিতাকে বাড়ি ছাড়ার সময়সীমা বেঁধে দেয় জুন মাসের ৩০ তারিখ পর্যন্ত। শুধু বাড়িই নয়, দুই সন্তান পাবন ও পায়েলকে নিয়ে চিরকালের জন্য পৃথিবীর সব বন্ধন ছিন্ন করে চলে গেলেন রিতা।
গত ১০ জুন রাতের কোনো এক সময়ে ২২৯ নতুন জুরাইন আলমবাগের (সোনারতরী) বাসায় দৈনিক ইত্তেফাকের বিশেষ সংবাদদাতা শফিকুল কবিরের সন্তান রাশেদুল কবিরের স্ত্রী ফারজানা কবির রিতা, তার ছেলে ইশরাক কবির পাবন বিন রাশেদ ও মেয়ে রাইশা রাশমিন পায়েল আত্মহত্যা করে।
রিতার মা মাজেদা বেগম কান্নাভেজা কণ্ঠে বলেন, ‘এক স্মৃতিই আমার মেয়ের সংসারটা তছনছ করেছে। সঙ্গে তিনটা জীবনও শেষ কইরা দিল। স্মৃতি এই কাজটা ক্যামনে করল। ওর মনের মধ্যে কি বোনের জন্য একটুও চিন্তা হয় নাই, বোনের ঘরের দুইটা সন্তানের জন্যও কি দয়া হয় নাই ওর?’ গতকাল সোমবার বাদ আসর রিতা ও তার দুই সন্তানের কুলখানি আলমবাগের মসজিদ ও মাদ্রাসায় অনুষ্ঠিত হয়েছে। মাজেদা বেগম বলেন, বাবা রাজ্জাক দেওয়ানের আর্থিক

অসচ্ছলতার কারণে স্মৃতির পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। তারপর ২০০০ সালে স্মৃতিকে বাসায় নিয়ে আসে রিতা। আলমবাগের হাজেরা খাতুন উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে তাকে ভর্তি করা হয়। সেখান থেকেই এএসসি পাস করে স্মৃতি। পরে সূত্রাপুরের ফজলুল হক মহিলা কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে।
মাজেদা বেগম অভিযোগ করেন, অজ্ঞাত মোবাইল ফোন নম্বর থেকে ফোন করে রাশেদুলের লোক পরিচয় দিয়ে মামলা তুলে নেওয়ার জন্য হুমকি দেওয়া হচ্ছে। মাজেদা বলেন, হুমকি দিয়ে বলা হয়, মামলা তুলে না নিলে রিতাদের মতোই তাকে মরতে হবে। অঝোরে কাঁদতে কাঁদতে মাজেদা বেগম সমকালকে বলেন, ‘ওরা আমার মেয়ে ও তার সন্তানকে মেরে আত্মহত্যা বলে চালানোর চেষ্টা করছে। এখন আমাকেও মেরে ফেলার ভয় দেখাচ্ছে।’
মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, এজাহারভুক্ত আসামি রিতার স্বামী রাশেদুল কবির গা ঢাকা দিয়েছে। অন্য আসামিদের ধরতে অভিযান চালানো হচ্ছে। তাছাড়া রাশেদুলের দ্বিতীয় স্ত্রী রাজিয়া সুলতানা স্মৃতিকে গ্রেফতারের জন্য তার কর্মস্থল পান্থপথের বসুন্ধরা সিটিতে অবস্থিত বাংলা নিউজ অনলাইন কার্যালয়ে রোববার রাতে গিয়েছে পুলিশ। তবে সেখানে স্মৃতিকে পাওয়া যায়নি। অন্যদিকে রিতার গাড়িচালক আল আমিনের অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেছে। পুলিশ জানিয়েছে, তাকে গ্রেফতারের জন্য কয়েকটি জেলায় পুলিশের একাধিক টিম অভিযানে রয়েছে। রিতার ভগি্নপতি কাজী মোহাম্মদ আরিফ সমকালকে বলেন, তিনজনের মৃত্যুর পর থেকেই রিতার নোহা গাড়ি (ঢাকা মেট্রো-গ-১৪-৬০৭৭) নিয়ে পালিয়ে যায় চালক আল আমিন। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা কদমতলী থানার উপপরিদর্শক (এসআই) গোলাম মোস্তফা সমকালকে বলেন, যেসব আলামত আমরা জব্দ করেছি তা পরীক্ষা করছে সিআইডি। আজকালের মধ্যে রিপোর্ট পাওয়া যাবে। গতকাল রাত পর্যন্ত এ ঘটনায় পুলিশ ৮ আসামির কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি।
পাবন ও পায়েলের আরও কিছু কষ্টগাথা
‘আজকে যদি আমি জন্ম না হতাম, তো আজকে আমার ভাইয়ের বা মা’র এই দিন দেখতে হতো না। কারণ আমি যখন আম্মুর পেটে ছিলাম তখন আমার মা ঞধশব ঈধৎব-এর জন্য ওই স্মৃতিকে নিয়ে এসেছিল। তুমি বলো তুমি যদি স্মৃতিকে বিয়ে না করতা, তুমি অন্য মেয়েকে বিয়ে করতা না। আর তুমি এই কথা বারবার বলতা শুধু আমার মাকে দোষী করার জন্য’_ বাবা রাশেদুল কবিরকে উদ্দেশ করে এই লেখাটি রাইশা রাশমিন পায়েল মৃত্যুর আগে ঘরের দেয়ালে লিখে গেছে।
বাবা রাশেদুলকে উদ্দেশ করে পায়েল লিখেছে, ‘আমাদের মোরার পর তুমি অভিয়াসলি আমার মাকে দোষ দিবা। বলতা যে কেমনে মা তার সন্তানকে মরে ফেলল। আর বলবা যে সুইসাইড টেন্ডেসি। কিন্তু সুইসাইড টেন্ডেসি কেন নিজেকে জিজ্ঞেস করো। এটা সত্যি কথা যে আমার মায়ের সুইসাইড টেন্ডেসি আছে কেন এটা যেনে নাও। তোমাদের অত্যাচারের জন্য।’ পায়েল আরেক জায়গায় লিখেছে, ‘এখন তোমাদের পাল্লা। আমরা আমার মায়ের দুরবোলতা হতে চাই না। এই জন্য আমি আর আমার ভাইয়া আমরা দুইজন আমাদের পথ বেছে নিসি।’
রিতার ভগি্নপতি কাজী মোহাম্মদ আরিফ সমকালকে বলেন, সাংবাদিক শফিকুল কবির কী ধরনের হুমকি দিতেন তা রেকর্ড করে রাখা হয়েছে।