রেনেলের মানচিত্রে(১৭৮১) কিংবা ময়মনসিংহ জেলা প্রতিষ্ঠাকালে(১৭৮৭) কালেক্টর রিপোর্টে কিশোরগঞ্জ নামের কোন উল্লেখ পাওয়া যায়নি।এমন কি ১৮৪৫ খ্রীষ্টাব্দে যখন বৃহত্তর ময়মনসিংহে জামালপুর মহকুমার সৃষ্টি হয় তখনো কিশোরগঞ্জ সম্পর্কে কোন আলোচনা পাওয়া যায় না। তবে এই এলাকায় ১৭৭০ খ্রীষ্টাব্দে বজ্রকিশোর (মতান্তরে নন্দকিশোর) প্রামাণিক কতৃক একটি মন্দির প্রতিষ্ঠার কথা পরবর্তী গেজেটিয়ার সমূহে লক্ষ করা যায় এবং এই মন্দির কে কেন্দ্র করে ঝুলন মেলার ঝমঝমাট সমাবেশের কথা আগেও আলোচনা করা হয়েছে।বর্তমান কিশোরগঞ্জ তৎকালীন জোয়ার হোসেনপুর পরগনার অন্তর্গত ছিল। সময়ের আবর্তে এই পরগনা নাটোরের মহারাজার জমিদারির অন্তর্ভুক্ত হয়। বিখ্যাত প্রামানিক পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা কৃষ্ণদাস প্রামাণিকের সাথে ব্যবসার সূত্র থেকে নাটোরের মহারাজার যোগাযোগ হয়। নাটোরের মহারাজা এই এলাকার কয়েকটি তালুক দেবসেবার জন্য কৃষ্ণদাস প্রামাণিককে ‘লাখেরাজ’ দেন। ১৭৯৩ খ্রীষ্টব্দে নাটোর মহারাজার জমিদারী নিলাম হয়ে গেলে খাঁজে কাফরে আরাতুন নামে এক আর্মানীয় বণিক তা ক্রয় করেন। এতে আরয়াতুনের সাথে প্রামাণিকের দীর্ঘ কাল মোকদ্দমা চলে। এই প্রংসগে উল্লেখ করতে যেয়ে শ্রীকেদারনাথ মজুমদার লিখেছেন, “এই জোয়ারের কতিপয় বৃহৎ বৃহৎ মহাল লইয়া আরাতুনের সহিত কাটাখালীর (কিশোরগঞ্জ) সুপ্রসিদ্ধ প্রামাণিকদিগের বহুদিন বিবাদ চলিয়াছিল”। এতে দেখা যায় যে,অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ প্রান্তেও কিশোরগঞ্জ এলাকাটি ‘কাটাখালী’ নামে সমধিক পরিচিত ছিল। জেমস টেলরের বর্ণনায় এলাকাটি জঙ্গলবাড়ী হিসেবেই উল্লেখ করা হয়েছে। এই আলোচনা থেকে ধারনা করা যায় যে, ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথন ভাগেই কিশোরগঞ্জ নামকরনটি হয়েছে। কিন্তু এই নামকরনের উৎস সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য প্রমান পাওয়া যায় না।তবে বিজ্ঞজনদের ধারনা ও জনশ্রুতি থেকে অনুমান করা যায় যে,বর্তমান ধ্বংস্প্রাপ্ত বত্রিশ প্রামাণিক পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা কৃষ্ণদাস প্রামাণিকের ষষ্ঠ ছেলে এবং প্রামাণিকের কীর্তি একুশ রত্নের স্রষ্টা নন্দকিশোর এর “কিশোর’ ও তাঁরই প্রতিষ্ঠিত স্থানীয় হাট বা গঞ্জের ‘গঞ্জ’যোগ হয়ে কিশোরগঞ্জ নামকরণ হয়েছে। প্রামাণিক পরিবারের বংশ তালিকা অনুযায়ী নন্দকিশোর প্রামাণিকের আনুমানিক কাল ১৭৫০-১৮১০ খৃষ্টাব্দ। এ হিসেবে তাঁর জীবদ্দশায় বা মৃত্যুর পর তাঁর নামানুসারে এলাকাটির নামকরন হওয়া অস্বাভাবিক নয়। বাংলাদেশের বহু এলাকার নামকরন কোন বিশেষ ব্যক্তির নামের সাথে ‘গঞ্জ’ যোগ করা হয়েছে। সে হিসেবে ‘কাটাখালীর’ নাম পরিবর্তন করে এলাকার নাম ‘কিশোরগঞ্জ’করা বিচিত্র নয়।

জেলা গেজেটিয়ারে অবশ্য বলা হয়েছে যে,কৃষ্ণদাসের ৭ ছেলের একজন বজ্রকিশোর এবং সম্ভবত তাঁর নামানুসারেই ‘কিশোরগঞ্জ’ নামকরন করা হয়েছে।তবে প্রথম জনশ্রুতি অধিকতর গ্রহনযোগ্য। মুক্তগাছার জমিদারের নামের সাথে ‘কিশোর’ যোগ হতে দেখা যায়। সে থেকেও কিশোরগঞ্জের নামকরনের কথা কেউ কেউ বলে থাকেন। কিন্তু তা ঠিক নয়, কারণ এ এলাকাটি তাদের জমিদারীর অন্তর্গত ছিল না।

কিশোরগঞ্জ ছাড়া জেলার বিভিন্ন এলাকার নামের উৎসের সন্ধান পাওয়া যায়। এ সম্পর্কে উল্লেখযোগ্য কাজ করেছেন সু-সাহিত্যিক ও বিশিষ্ট সংগ্রাহক মোহাম্মদ সাইদুর। জেলা পাব্লিক লাইব্রেরীর সাহিত্য পত্রিকা ‘সাহিত্য সাময়িকি সৃষ্টি’র বিভিন্ন সংখ্যায় তা প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়াও কিছু কিছু আলোচনা হয়েছে বিভিন্ন স্থানের নামকরণ নিয়ে। পরবর্তী পোষ্টগুলোতে  কিছু আলোচনা হবে নামকরণ নিয়ে ।